মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি:
মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া গ্রামে সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ভূক্তভোগী সাংবাদিক আনিসুর রহমান বাদী হয়ে মুন্সীগঞ্জ আমলি আদালত ২ এ সিনিয়র জুডিশয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট নুসরাত শারমিন এর আদালতে ভন্ড কবিরাজ শাহজালাল ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। মামলার বিষয়টি ওই আদালতের ব্রেঞ্চ সহকারী (পেসকার) ফরিদ হোসেন নিশ্চত করেছেন।
জানাগেছে, উপজেলার রসুনিয়া গ্রামের মৃত আব্দুল মান্নান এর ছেলে শাহজালাল খান কবিরাজ দির্ঘ দিন যাবৎ কবিরাজী চিকিৎসা ও জ্বীন ছাড়ানোর নামে বিভিন্ন অপচিকিৎসা দিয়ে আসছেন। এছাড়া নারীদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসার নামে নারীদের নিয়ে নাচ গানের বিভিন্ন ভিডিও চিত্র তার বিরুদ্ধে ভাইরাল হয়েছে। এ সমস্ত ঘটনা নিয়ে ভূক্তভোগী সাংবাদিকসহ আরো কয়েকজন বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিউজ প্রকাশ করলে বুধবার সন্ধা ৬টার দিকে সিরাজদিখানের নিমতলা হতে বাড়িতে ফেরার পথে ভুক্তভোগী সাংবাদিকের উপর হামলা চালিয়ে তাকে মাথায় আঘাত করে তার ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে শাহজালাল কবিরাজসহ আরো কয়েকজন।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী সাংবাদিক আনিসুর রহমান বলেন, আমি শাহ জালাল কবিরাজের অপকর্ম নিয়ে অনেকগুলো নিউজ করেছি। নিউজ করায় সে আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আসছিল। বুধবার আমি সিরাজদিখানে নিমতলায় একটি নিউজ করতে যাই। তার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে ফেরার পথে শাহজালাল পান কবিরাজসহ কয়েকজন সন্ত্রাসী আমার উপর হামলা চালায়। শাহজালাল আমার মাথায় রড দিয়ে আঘাত করে আমার ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আমি বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেছি।
স্থাণীয়রা বলেন, পান কবিরাজ আগে পল্লি বিদুৎতের লাইনম্যান ছিল। সে মিটার দেওয়ার কথা বলে অনেকের টাকা আত্নসাৎ করেছেন। পরে হঠাৎ করে সে কবিরাজ বনে গিয়ে নারীদের বাড়িতে রেখে নাচগান করেন এবং প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ হতে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এর আগে সে পবিত্র কোরয়ান ছুড়ে ফেলায় তার আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়া হলেও সে প্রভাবশালীদের ছত্র ছায়ায় আবার আস্তানা গেড়ে অপচিকিৎসা দিচ্ছেন। এর আগে সিরাজদিখান থানা পুলিশকে পান কবিরাজ একটি ল্যাবটব দিয়ে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দেন।
এ ব্যাপারে শাহাজালাল কবিরাজ বলেন, আমি নারীদের নিয়ে নাচগান করে অপচিকিৎসা দেইনা দুই নাম্বার চিকিৎসা করিনা এবং কোন সাংবাদিকেও মারধর করিনাই। থানায় ল্যাপট্যাব দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছে সার্কেল এসপি একটি ল্যপটপ দাবী করেছিলো তাই আমি তাকে উপহার দিছি আমার থানায় দিছি। আমি সামনে চেয়ারম্যান নির্বাচন করমু তাই আমি দিছি।
এ ব্যাপারে সিরাজদিখান থানার ওসি শাহেদ আল মামুন বলেন,আমার থানা ৫ আগষ্টে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় পান কবিরাজ থানায় একটি ল্যাপটব নিয়ে আসে। আমিতো জানিনা সে পান কবিরাজ আগে তাকে চিনতাম না। সাংবাদিকের ওপর হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন এ ব্যাপারে আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
উল্লেখ্য রশুনিয়া গ্রামের শাহ জালাল কয়েক বছর আগেও এলাকায় কারেন্টের মিস্ত্রি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এখন তিনি পান কবিরাজ নামে পরিচিতি লাভ করেছেন। তিনি প্রচুর পান খান বলে তাকে পান কবিরাজ বলে লোকে। পল্লি বিদ্যুতের লাইন ম্যান থেকে পান কবিরাজ হয়ে ওঠা শাহ জালাল দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার মাধ্যমে মানুষকে বোকা বানিয়ে ভুয়া কবিরাজি চিকিৎসা দিয়ে আসছে। তারপরও মানুষ তার কৌশল ও আচরণে ‘চুনকে দই’ ভেবে প্রতারিত হয়ে আসছে বহু আগে থেকেই। তার খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন জেলার অন্তত কয়েক হাজার মানুষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তেমন শিক্ষিতও নন তিনি। নেই কবিরাজি বা হেকেমি শিক্ষা। তারপরও নাকি তিনি কবিরাজ! স্থানীয়দের ভাষ্য, পান কবিরাজ শাহ জালাল ২০১০ সাল স্বপ্নে সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক আশীর্বাদ পেয়েছেন বলে তার কিছু দালালদের দিয়ে এলাকায় প্রচারণা চালায়। আস্তানা গড়ে তোলার পর সেখানে চিকিৎসার নামে চলে প্রতারণা। শাহ জালাল পান কবিরাজ দীর্ঘদিন যাবৎ সংসারে অশান্তি, স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব, বন্ধ্যাত্ব, পছন্দের মানুষকে পাইয়ে দেওয়া, অবাধ্য সন্তানকে বশীকরণসহ নানাবিধ সমস্যার মৌখিক সমাধান দিয়ে আসছিলেন। তিনি জ্বিন দ্বারা কবিরাজি চিকিৎসা করেন মর্মে প্রতারণার অভিনব কৌশল হিসেবে প্রতি রাতে তার নিজ বাড়িতে আসন বসান। এ কাজে তার কাছে থাকা জ্বিন তাকে সহযোগিতা করে বলে তিনি রোগীদেরকে বোঝান। এসব ক্ষেত্রে তিনি প্রতারণার অংশ হিসেবে প্রতি দিন তার নিজ বাড়িতে আসন বসান। নানা সমস্যা নিয়ে আগত রোগীদের ওই জ্বিনের আসর থেকে চিকিৎসা স্বরূপ কারো বাড়িতে শত্রুতাবশত তাবিজ, কারো বাড়িতে পুতুল পুঁতে রাখা আছে এবং এসব কারণেই তারা ভুগছেন মর্মে রোগীদের বাগে আনতেন। জ্বিনের সাহায্যে রোগীদের বাড়িতে পুঁতে রাখা তাবিজ বা পুতুল তুলে এনে সমস্যার সমাধান করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন শাহ জালাল। জ্বিনের আছড় ছাড়ানোর চিকিৎসায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকাসহ এর সমপরিমাণ মালামাল নেন তিনি।
এছাড়া বাড়ি বন্ধকরণ, জ্বিনের মাধ্যমে তাবিজ-কবজ তুলে আনার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা নেন তিনি। সাথে এক নজর তাকিয়ে দেখার জন্য জনপ্রতি ১২০ টাকা করে নজরানা ফি নেন এই পান কবিরাজ। প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগী ফতুল্লা থানার গৃহবধূ রোসনা বেগম অভিযোগ করেন, আমার কিছু সমস্যা জনিত রোগের কারণে পান ফকিরের কাছে যাই। প্রথমে একশ এক টাকা ফি নেন। পরবর্তীতে তেল পড়া, পানি পড়া দিয়ে এক হাজার একশ টাকা হাতিয়ে নেন। এতে কোনো সুফল না পেয়ে পুনরায় তার কাছে গেলে ছাগল গোসল দেয়ার নামে আমার কাছ থেকে আট হাজার ছয়শ টাকা হাতিয়ে নেন। কাজ না হওয়াতে আমি একথা তাকে জানাতে এসেছিলাম। স্থানীয় রফিকুল, মোঃ রহমত উল্লাহ, পাপড়ি দেবনাথসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, পান ফকির স্বপ্নে আধ্যাত্মিক শক্তির বলীয়ান হয়েছেন এবং যেকোনো মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন মর্মে কথিত পান ফকিরের দালালরা এই বলে প্রচারণা চালান। এতে অসহায় অজ্ঞ লোকজন দূরদূরান্ত থেকে এই ভন্ড ফকির বা কবিরাজের কাছে আসেন। তার জিন দ্বারা তাবিজ-কবজ তুলে আনার বিষয়টিম প্রতারণার কৌশল মাত্র। প্রকৃত পক্ষে তিনি কোন জ্বিন বস করতে পারেননি, তিনি জীবনে কখনো জ্বিন দেখেছেন কিনা তা নিয়েও স্থানীয়দের সন্দেহ রয়েছে। এ বিষয়ে রশুনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবু সাঈদ বলেন, আসলে ও একটা ভণ্ড প্রতারক। এক সময় পল্লি বিদ্যুরে লাইনম্যান হিসেবে কাজ করে বাড়ি বাড়ি। পরে শুনি ও নাকি কবিরাজ হয়ে গেছে। স্বপ্নে ও অলৌকিক শক্তি পেয়েছে, যা দিয়ে মানুষের সব রোগের চিকিৎসা করে। ওর কিছু দালাল আছে যারা ওর পক্ষ নানা অলৌকিক কথা প্রচার করে এবং ওকে এক আধ্যাত্মিক মানুষ হিসেবে তুলে ধরে। ওর প্রতারানা শিকার হয়েছে ও হচ্ছে অনেক নিরীহ মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এসে। তবে স্থানীয়দের কাছে এখন ওর তেমন গুরুত্ব নাই। দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন রোগীরা আসে। প্রতারণার কারণে ওর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, জেল খেটেছে। আবার স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে ওর অপচিকিৎসা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের জোড়ালো ভূমিকা রাখতে হবে। ভণ্ড কবিরাজের বা ফকিররা নানা তদবির, সাধক-কবিরাজদের তেল-পড়া, আটাপড়া, বাটি চালান, ঘটি চালান আর যাদু-টোনা—এসবে মানসিক রোগ ভালো হয় না বরং ক্ষেত্র বিশেষে রোগ চরম আকার ধারণ করে, ঘটে দুর্ঘটনা। পরিবারের জন্য করুণ পরিণতি বয়ে আনে। এসব ভণ্ড কবিরাজরা নানা কৌশলে লোক জড়ো করে সব ধরনের রোগ নিরাময়ের শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে এলাকার সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা নিচ্ছেন। এদের চিকিৎসার অন্যতম উপাদান হল উদ্ভট সব পন্থায় মানুষকে ‘বিশ্বাস’ করানো যে, ‘প্রকৃত’ চিকিৎসা চলছে।
শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ এসব মানুষ সহজেই মেনে নেয় কারণ তারা কবিরাজি যুগযুগ ধরে এভাবেই করতে দেখেছে। এক শ্রেণীর লোক আছেন যারা বলে বেড়ায়, অনেক চিকিৎসা আছে যা ডাক্তাররা সারাতে পারেন না। কবিরাজ পারেন। এই সুযোগে কবিরাজ কিছু অর্থ হাতিয়ে নেয়। অনেক অ্যাকাডেমিক শিক্ষিত লোক আছেন তারা কুসংস্কারে বিশ্বাসী। ‘শিক্ষার-অভাব একারনে কবিরাজি চিকিৎসা নেয়, একথাটিও অর্ধসত্য। তবে শুধু ‘বিশ্বাস ও ‘স্তুতির উপর এদের অপচিকিৎসার ব্যবসা নির্ভরশীল। আসলে দরকার সুশিক্ষা, আধুনিক শিক্ষা, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। অন্ধ বিশ্বাস ও অপচিকিৎসা থেকে মুক্তি পেতে হবে। সরকারের উচিত মানুষকে সচেতন করা, আধুনিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা পালন করা।