মেঘনা পাড়ে প্রায়শই সম্মুখ যুদ্ধে অস্ত্রের ঝনঝনানি দুই বংশের অর্ধশত বছরের বিরোধে নিহত ১৪ আহত কয়েক হাজার মানবিকতার ভাষা যেখানে গুমরে কাঁদে বার বার উদ্যোগ নিয়েও শান্তি ফিরছেনা
ছাইদুর রহমান নাঈম, কিশোরগঞ্জ থেকে
মেঘনা পাড়ের সাথে সবুজে ঘেরা একটি পরিপাটি গ্রাম। পাশাপাশি আরো কিছু গ্রাম রয়েছে দেখার মতো সুন্দর৷ কিন্তু মেঘনা নদীর পানি যতটুকু স্বচ্ছ তার বিপরীতে সৌন্দর্যের আড়ালে চাপা রয়েছে ভয়ংকর এক বাস্তবতা৷ নদীর পানির মতো শীতল ও স্বচ্ছ নয় এখানকার অধিকাংশ বসবাসকারী মানুষের মন৷ দুনিয়া সমাজ পরিবর্তন হলেও তাদের মন মানসিকতার মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলে আসা হিংসা এখনো চলমান৷ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়েই বেখেয়ালি এসব গ্রামের মানুষ৷ হরহামেশাই মারামারি খুন, আহত করা আর লুটপাটে পৈশাচিক আনন্দ পান এখানকার মানুষেরা৷ কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কয়েকটি গ্রামের ভয়াবহ বংশের বিরোধ।
যেভাবে দুই বংশের বিরোধ তৈরি হয়
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগের কথা। কর্তা বংশের ওয়াছিল উদ্দিন কর্তা ছিলেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। আজ থেকে ৫৬ বছর আগে সেই সময় মৌটুপি গ্রামে একটি সালিস বসে। ওয়াছিল সালিসে রায় ঘোষণা করেন। রায় চ্যালেঞ্জ করে বসেন সরকারবাড়ির আ. ওহাব সরকার। বিষয়টি তখন ভালোভাবে গ্রহণ করেন নি ওয়াছিল উদ্দিন। নিজের দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করায় তার মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে৷
এ ঘটনায় তখন উপস্থিত থাকা স্থানীয় কয়েকজন লোকজনের ভাষ্য, তখন ওয়াছিল উদ্দিন বলেন, ‘কর্তার রায় চ্যালেঞ্জ করছে সরকার। আমার আর কী দরকার?’ সেই থেকে কর্তা বংশ ও সরকার বংশের বিরোধ শুরু। যা আজো চলে আসছে। প্রজন্ম পরিবর্তন হলেও হিংসার কোন পরিবর্তন হয়নি।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, এই সালিসের কিছুদিন পর আ. ওহাব সরকারকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে বিরোধ আরো তীব্রতর হয়৷ এর সঙ্গে কর্তা বংশের লোকজন জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। তিন বছর পর ওয়াছিল উদ্দিন কর্তার ছেলে কফিল উদ্দিন কর্তা খুন হন। সেই ঘটনায় সরকার বংশের নাম আসে। সেই থেকে দুই বংশের বিরোধ পাকাপোক্ত হয়। এর পর থেকে বংশ দুটির লোকজন বিবাদ ছাড়া কোনো বছর পার করেছেন, এমনটা হয়নি। ৫৬ বছর ধরে চলছে এই বিরোধ।
৫৬ বছরে ঝরেছে ১৪ প্রাণ
গ্রামবাসীর দেওয়া তথ্যমতে, ৫৬ বছরে দুই পক্ষের ১৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন শত শত মানুষ। মামলা হয়েছে শতাধিক। সুযোগ পেলেই এক পক্ষ অপর পক্ষের আসবাব, গবাদিপশু, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ সর্বস্ব লুটে নিতে এতটুকু সময়ক্ষেপণ করে না। রান্নার চুলা ভেঙে ফেলে। শৌচাগার নিশ্চিহ্ন করে দেয়। টিউবওয়েল উপড়ে ফেলে। পাকা ফসলে দেয় মই।
সুযোগ পেলেই এক পক্ষ অপর পক্ষের আসবাব, গবাদিপশু, স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ সর্বস্ব লুটে নিতে এতটুকু সময়ক্ষেপণ করে না। বছরের পর বছর সংঘর্ষের কারণে বংশ দুটির প্রায় প্রত্যেকের নামে অন্তত একটি করে মামলা আছে। তবে বেশির ভাগের নামেই আছে একাধিক মামলা। এ কারণে কারও পক্ষে স্থায়ী কাজ করা সম্ভব হয় না। ব্যবসা টিকে থাকে না। ফসল ফলাতে জমিতে যাওয়া যায় না। এ কারণে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। কেউ কেউ নিঃস্ব।
বংশ দুটির বেশির ভাগ কৃষিজমির মালিক এখন অন্য গ্রামের মানুষ। সংঘাত আর মামলার আসামি হওয়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে অনেকে এরই মধ্যে গ্রাম ছেড়ে শহরে বসবাস করছেন। আবার অনেকে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। সংঘর্ষ ও মামলার ব্যয় মেটানোর আর্থিক জোগান দিতে হয় প্রবাসীদের।
বিরোধের আগুন এখন ভিন্ন গ্রামে
সরকার ও কর্তা বংশের বিরোধের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে তাঁদের গ্রামের অন্তত সাতটি বংশ ও বেশ কয়েকটি লাগোয়া গ্রামে। ওই সব বংশ ও গ্রামের মানুষেরা এখন কোনো না কোনো পক্ষের হয়ে সংঘর্ষে জড়ান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌটুপি গ্রামের বড়বাড়ি, দক্ষিণপাড়া, মান্নাপুর, শেরবাজ ও পান্ডাবাড়ি অনেক বছর ধরে কর্তা বংশের পক্ষ নিয়ে সংঘর্ষে অংশ নেয়। সরকার বাড়ির হয়ে সংঘর্ষে অংশ নেয় গ্রামটির খালপাড় ও মাইট্টাইল্লাহাটি। এ ছাড়া লাগোয়া গ্রাম মেন্দিপুরের মানুষ আছেন সরকার বংশের পক্ষে।
সাদেকপুর ইউনিয়নের সাদেকপুর, রসুলপুর এবং একই উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই বংশের সঙ্গে সংঘর্ষ ইস্যুতে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল সরকার ও কর্তা বংশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষের রেশ ধরে ১৮ এপ্রিল ভবানীপুর গ্রামে বংশ দুটির অনুগতরা সংঘর্ষে জড়ান। এ ঘটনায় সরকার বংশের পক্ষের মিজান মিয়া নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। আহত হন ২০ জন। একই ইস্যুতে আরও কয়েকটি গ্রামে এখন উত্তেজনা চলছে।
কি ঘটেছে মৌটুপি গ্রামে?
গত এক বছরে উভয় পক্ষের মধ্যে বড় সংঘর্ষ হয় পাঁচবার। এ ঘটনায় দুজন করে উভয় পক্ষের মোট চারজন খুন হন। প্রতিটি খুনের ঘটনার পর এক পক্ষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওই সুযোগে প্রতিপক্ষরা বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারবাড়ির একজন বলেন, ভাঙা ঘর এখন আর কেউ সংস্কার করে না। কারণ, সবাই জানেন, যেকোনো সময় সংঘর্ষ হবে।
এবারের সংঘর্ষে কর্তাবাড়ি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বংশটিতে একজন নারী ছাড়া সবাই বাড়িছাড়া। বাড়িতে থাকা কর্তাবাড়ির গৃহবধূ তামান্না বেগমের বসতঘরটি অক্ষত আছে। শিশুসন্তানকে নিয়ে তিনি এখন পর্যন্ত বাড়িতে অবস্থান করছেন। তবে চারপাশের সব কটি ঘর মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। তামান্না বেগম বলেন, ‘চুলা নাই। আগুন নাই। রান্ধা নাই। হুগনা খাওন খাইয়া টিইক্কা আছি। বিয়ার পর থাইককা কাইজ্জা ছাড়া আর কিচ্ছু দেহি নাই।’
কর্তাবাড়ির সীমানায় গ্রামের একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা ও কমিউনিটি ক্লিনিক। এবার সংঘর্ষের পর ইমাম মসজিদ ছেড়ে বাড়ি চলে যান। মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে গেছে। দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে কেবল দুজন শিক্ষক বসে আছেন। কোনো শিক্ষার্থী নেই।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আজহারুল হক বলেন, প্রতিবছর শিক্ষার্থী কমছে। কয়েক বছর আগে শিক্ষার্থী ছিল তিন শয়ের ওপরে। কমে গত বছর ছিল ১১৮ জনে। এই বছর মাত্র ৬৮ জন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে উপস্থিতি বাড়বে। আগেও এমন হয়েছিল।
সরকার বংশের ইউপি চেয়ারম্যান শেফায়েত উল্লাহ সরকার বলেন, কর্তারা মাইরা যাইব আর আমরা বইয়া থাহুম? এইটা কোনো জীবন হইতে পারে না।
স্থানীয় লোকজন জানালেন, সংঘর্ষের পর কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ আছে। গ্রামটির হাজি বংশের আসাম উদ্দিন (৭৫) বলেন, ‘মৌটুপির অবস্থা গাজাবাসীর মতো হয়ে গেছে। মাটি আছে, ভিটা নেই। খেত আছে, চাষ নেই। ধ্বংস আর ধ্বংস।’
সরকারবাড়িতে গিয়ে কথা হয় বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান শেফায়েত উল্লাহ সরকারের সঙ্গে। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য। বর্তমানে সরকার বংশ তাঁর নির্দেশে চলে। বংশ বিরোধে তাঁর দুই ভাই হেদায়েত উল্লাহ ও উবায়দুল্লাহকে হারান তিনি। সরকার বংশের দাবি, কর্তাবাড়ির লোকজনের হাতে দুই ভাই খুন হন।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কর্তা বংশের তোফাজ্জল হোসেন, শেফায়েতকে পুলিশ গ্রেপ্তার করুক। আমি গ্যারান্টি দিলাম, গ্রামে শান্তির বাতাস বইবে। বেহেশতের সুখ পাইব সবাই।
এই বিরোধের শেষ কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে শেফায়েত উল্লাহ প্রথমে এর উত্তর কর্তা বংশের লোকেদের জিজ্ঞেস করতে বলেন। পরে বলেন, ‘কর্তারা মাইরা যাইব আর আমরা বইয়া থাহুম? এইটা কোনো জীবন হইতে পারে না।’কর্তাবাড়ির নেতৃত্বে আছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও ইউনিয়নটির সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন। কথা হয় মুঠোফোনে। একই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকারবাড়ির নেতৃত্বে থাকা শেফায়েত উল্লাহকে গ্রেপ্তার করলে সমাধান সম্ভব। তাঁর ভাষায়, ‘শেফায়েতকে পুলিশ গ্রেপ্তার করুক। আমি গ্যারান্টি দিলাম, গ্রামে শান্তির বাতাস বইবে। বেহেশতের সুখ পাইব সবাই।’
শান্তি ফেরাতে কমিটি তবুও অশান্তি চলমান
সংঘর্ষ থামাতে ও গ্রামে শান্তি ফেরানোর ভাবনা থেকে সমাজকর্মীরা শান্তি কমিটি গঠন করেন। কমিটি ২১ সদস্যের। কমিটির প্রধান আনোয়ার শেখ। শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা হতাশ হলেও হাল ছেড়ে দেননি। শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ চলমান রাখবেন।
সংঘর্ষ থামাতে ও গ্রামে শান্তি ফেরানোর ভাবনা থেকে করা হয়েছে শান্তি কমিটি। তবে সুফল পাওয়া যায়নি। সংঘর্ষ থামাতে ও গ্রামে শান্তি ফেরানোর ভাবনা থেকে করা হয়েছে শান্তি কমিটি। শান্তি কমিটি বংশ দুটির মধ্যে বিরোধ না মেটার বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে। প্রথমত, পুরোনো বিরোধের কারণে যুগ যুগ ধরে এক পক্ষ অপর পক্ষকে আপন ভাবতে না পারার সংস্কৃতি। দ্বিতীয়ত, সংঘর্ষকে কোনো পক্ষই মন্দ ভাবে না; বরং প্রভাব ধরে রাখার এই সংঘর্ষকে বংশের আভিজাত্য মনে করা হয়। পুরো বছর পরিবারের সঙ্গে নিজ বাড়িতে শান্তিতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা দুই বংশের কারও নেই। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা আর কারাগারে যাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তাঁদের। পূর্ববিরোধ আর প্রভাব—এই দুই থেকে দুই বংশের কেউ এখনো বের হয়ে আসতে পারছে না। সর্বোপরি, অর্ধশতকের বেশি সময়ের মধ্যে একটি হত্যা মামলারও চূড়ান্ত বিচার না হওয়া।
দুই বংশের ৫৬ বছরের বিরোধ মেটাতে ‘শান্তি কমিটি’ গঠনের পরও সংঘর্ষ, আহত ৩০ কমিটির সদস্য মাওলানা আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘সত্য হলো, দুই বংশে শান্তি ফিরিয়ে আনা শুধু কঠিন না, মহাকঠিন। সব হারিয়েও সংঘাতের মধ্যে তাঁরা আনন্দ পান।’
প্রশাসন কী বলে?
মৌটুপি গ্রামটি শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে। নদীলাগোয়া। গ্রামে যেতে ডুবোসড়ক ব্যবহার করতে হয়। বর্ষায় সড়কটি ডুবে যায়। তখন নৌকা ছাড়া গ্রামে যাওয়ার বিকল্প থাকে না। এ কারণে পুলিশ ও প্রশাসনকে গ্রামের শান্তি–শৃঙ্খলা নিয়ে সব সময় বাড়তি চিন্তায় থাকতে হয়।
ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শবনম শারমিন বলেন, মৌটুপি গ্রামে শান্তি ফেরাতে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছেন তিনি। সাধারণ প্রক্রিয়ায় মৌটুপি গ্রামে শান্তি ফিরবে না। বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন।
ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার ফুয়াদ রুহানী বলেন, মৌটুপি গ্রাম অশান্ত হতে বড় কারণ লাগে না। তবে আর যেন অশান্ত না হয়, সে বিষয়ে পুলিশ সতর্ক আছে।