একজন মোশাররফ করিম অভিনয় না করলে কী হতো?

বিনোদন ডেস্ক:

সফলতার পেছনে কমবেশি সবাই ছোটেন। কিন্তু তিনি ঠিক সফলতার পেছনে ছোটেননি। তিনি বিশ্বাসী কাজে, পরিশ্রমে, লেগে থাকায় এবং অবশ্যই সততায়। কারণ, অভিনেতাকে সৎ হতে হয়। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি ক্যারিয়ারে তিনি সব সময় সৎ থেকেছেন। কখনো তেমন স্রোতে গা ভাসাননি। তাঁর কথা, ‘শুরু যখন করেছিলাম, তখন সফল না হলেও সৎ থেকে কাজ করে যেতাম। পরিশ্রম কখনোই বিফলে যায় না।’

বলছি, অভিনেতা মোশাররফ করিমের কথা। আজ এই অভিনেতার জন্মদিন। এ বছর ৫৪–তে পা দিলেন। মোশাররফ হোসেন নামের এ মানুষটি মোশাররফ করিম হয়ে নাটকে জন্ম না নিলে কী হতো?

মঞ্চ নাটকে ৯০ দশকের শুরুতে তিনি নীরবে অভিনয় শুরু করেছিলেন। এর শুরুর গল্পটাও বেশ মজার। তরুণ মোশাররফ করিম শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে উঠেছেন। নাটক–সিনেমা দেখে বেড়ে উঠেছিলেন, তার মধ্যমণি ছিলেন অভিনেতার বাবা। তিনি বাবার সঙ্গেই মঞ্চ নাটক দেখতে যেতেন। সেসব নাটকে হুমায়ূন ফরীদি, আফজাল হোসেন, তারিক আনাম খানদের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতেন। সেই মানুষগুলোকেই আবার বেইলি রোডের রাস্তার মোড়ে দেখতেন, প্রাণখোলা হাসিতে আড্ডায় মেতেছেন। মঞ্চ এবং বাইরে প্রাণবন্ত আড্ডা দেওয়া মানুষগুলো তাঁকে অভিনয়ে অনুপ্রাণিত করেন। এভাবেই শুরু করেছিলেন। তারপর নিজেই একদিন মঞ্চে যোগ দেন। প্রথম অভিনয়ের জন্য ‘নাট্যকেন্দ্র’ সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ছিটকে পড়ার ভয় ছিল। কিন্তু সৎসাহস নিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রসঙ্গে সত্য কথা বলেন। যোগ্যতায় চাওয়া হয়েছিল এইচএসসি পাস, তিনি তখনো পাস করেননি, এই যা। সেই সত্যের চর্চা এখনো তিনি করে যাচ্ছেন।

থিয়েটারের পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া ছিল না। ছোট ছোট চরিত্রে দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেন। কিন্তু শুরু থেকে চরিত্রের প্রতি ভালোবাসাটা সব সময় একই রকম থেকে গেছে। সেটা ‘অতিথি’ নাটক হোক কিম্বা ২০০৪ সালে তৌকির আহমেদের পরিচালনায় ‘জয়যাত্রা’ সিনেমাই হোক। ‘জয়যাত্রা’য় দই বিক্রেতার চরিত্রে দেখা যায় মোশাররফ করিমকে। চরিত্রের ব্যাপ্তি ছিল অল্প সময়। কিন্তু চরিত্রের প্রতি ভালোবাসা ছিল অগাধ। কীভাবে চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা যায়, এটা নিয়ে দীর্ঘদিন সময় দিয়েছেন। চরিত্র নিয়ে সেই ভালোবাসা এখনো একই রকম রয়েছে। এর আগে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি চরিত্র ছোট–বড় এটা দেখি না। গুরত্বটা আসল। অভিনয়ের আলাদা জায়গা থাকলে যেকোনো চরিত্রের অভিনয়ে আপত্তি নেই। বরং এমন চরিত্রেই আমাকে ডাকা হয় না।’

মোশাররফ করিম

মোশাররফ করিমইনস্টাগ্রাম

নাটকের অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে কত কথা শোনা যায়। কোনো কোনো তারকা সময়মতো শুটিংয়ে যান না, দায়বদ্ধতার জায়গায় নড়বড়ে। প্রেম–বিয়ে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তো আছেই। এসব কোনো কিছুই মোশাররফ করিমকে ছুঁতে পারে না। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালক–অভিনয়শিল্পী হিসেবে জুটি গড়া নির্মাতা রেদওয়ান রনি জানালেন, একসঙ্গে তাঁরা অনেক নাটকের শুটিং করেছেন। সব সময় সহায়তা পেয়েছেন মোশাররফ করিমের কাছ থেকে।’

শিডিউল ফেঁসে গেছে, এমন অভিযোগ নিয়ে কেউ ডিরেক্টরস গিল্ড, অভিনয় শিল্পী সংঘ বা প্রযোজকদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেননি। সমিতিগুলো এই তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে।

তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট ‘ক্যারাম’ নাটক দিয়ে। পরিশ্রমই তাঁর ভাগ্যটাকে গড়ে দিয়েছিল। কারণ, সেই নাটকের শুটিংয়ের আগে দেশের বাইরে একটি শুটিংয়ে যাওয়া কথা ছিল। হাতে ছিল একটি অপশন। কিন্তু ‘ক্যারাম’–এর চিত্রনাট্য এতটাই পছন্দ হয় যে প্রথমবার বিদেশে শুটিংয়ে যাওয়ার চিত্রনাট্যে আর কাজ করেননি। তারপরে তো ইতিহাস। সেই থেকে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছেন। এখনো যেন তিনি অভিনয়ে চিরসবুজ। নানা রূপে নিজেকে ভাঙতে পেরেছেন বলেই তিনি মোশাররফ হোসেন থেকে মোশাররফ করিম হয়ে উঠতে পেরেছেন। বাবার নাম থেকেই করিম নামটি নেন এই অভিনেতা।ক্যারিয়ারে নানা সময় বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়েছে। কিন্তু কখনোই ভেঙে পড়েননি। ধৈর্য ধরে এগিয়ে গিয়েছেন। যার ঝুলিতে ‘বনলতা সেন’, ‘সাকিন সারিসুরি’, ‘এফএনএফ’, ‘সিকান্দার বক্স’, ‘সেই রকম চা খোর’, ‘জমজ’, ‘বিহ্যাইন্ড দ্য সিন’সহ অনেক প্রশংসিত নাটক জমা হয়েছে। গেল ঈদের কথাই যদি বলা যায়, ‘জায়গা খায় জায়গায় ব্রেক’ নাটকটি ভক্তদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

আঞ্চলিক ভাষায় অভিনয় করলেও ভাষার বিকৃতি মোশাররফ করিমের ক্ষেত্রে খুবই কম দেখা যায়। পাবনা, নোয়াখালী, বরিশাল, ময়মনসিংহ এলাকাসহ বিভিন্ন জেলার ভাষায় খুব সহজেই তিনি মানিয়ে যান। অনেকের প্রশ্ন বিভিন্ন জেলার ভাষা কীভাবে রপ্ত করেছেন তিনি। এই নিয়ে মোশাররফ করিমের গুরু তারিক আনামের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। জানা গেল এই চর্চার শুরু মঞ্চ নাটকে অভিনয়ের শুরু থেকে।

তারিক আনাম খান বলেন, ‘বিভিন্ন জেলার মানুষের ভাষা খুব সুন্দর করে বলতে পারেন মোশাররফ করিম। থিয়েটারে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ আসতেন। মোশাররফ তাঁদের ভাষা নকল করতেন। এ জন্য সিলেটি, ময়মনসিংহের ভাষা তাঁর জন্য সহজ হয়ে গেছে। নানা বিষয় নিয়ে ছোট ছোট হিউমার তাঁর মধ্যে আগে থেকেই ছিল। মোশাররফের এ চর্চা আমরা গ্রুপের মধ্যেও উৎসাহিত করতাম। আমরা চাইতাম সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলুক।’

নতুন অভিনয়শিল্পীদের যেন আশ্রয়স্থল মোশাররফ করিম। সবাই যখন প্রথম এই অভিনেতার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে জড়োসড়ো, তখন তিনিই সেই তরুণ অভিনয়শিল্পীদের দায়িত্ব নিয়ে নেন। এই অভিজ্ঞতা কমবেশি মেহজাবীন চৌধুরী, সাবিলা নূর, তানজিন তিশা সাফা, কেয়া কেয়া পায়েল, তানিয়া বৃষ্টিসহ বেশির ভাগ অভিনয়শিল্পীরই রয়েছেন। সম্প্রতি মোশাররফ করিমের সঙ্গে অভিনয় করে আলোচনায় এসেছেন তানিয়া বৃষ্টি। এই অভিনেত্রী বলেন, ‘মোশাররফ করিম ভাইয়ার সঙ্গে প্রথম অভিনয় করি “আমি বাবা হতে চাই” নাটকে। সেদিন খুবই নার্ভাস ছিলাম, ভয়ে কাঁপছিলাম। এত বড় একজন তারকা। তার ওপর শুরুতেই ছিল ঝগড়ার দৃশ্য। ডায়ালগ উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছিল। প্রথম সবাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ভয়ের কিছু নেই, মোশাররফ ভাই ফ্রেন্ডলি মানুষ।’ শুটিংয়ের প্রথম শর্ট দেওয়ার মোশাররফ করিম ভাই বললেন, ‘তুই ভালো করবি। এটা আমার কাছে ছায়ার মতো।’ মোশাররফ করিমের জন্মদিনে মিরাক্কেল খ্যাত আরেক অভিনয়শিল্পী জামিল হোসেন ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, ‘আপনি আমার অভিনয়ের জীবনের স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি শুভ জন্মদিন প্রিয়।’

ভারতের সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম

ভারতের সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিমছবি: ফেসবুক

ইউটিউবে ‘সাকিন সারিসুরি’ নাটকের একটি পর্বের নিচে রইচ উদ্দিন নামে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘মোশাররফ করিম একটা নাটকের আলাদা অধ্যায়। এমন প্রাণ খোলা অভিনয় খুব কম অভিনেতার মধ্যে দেখা যায়। কী সুন্দর সংলাপ বলা ধরন। যেখানে কুরুচিপূর্ণ কিছু নেই, এখনকার মতো জোর করে হাসানোর চেষ্টা নেই। সহজেই চরিত্র হয়ে যেতে পারেন, এমন একজন অভিনেতা মোশাররফ করিম।’ গ্রামীণ কিম্বা শহরের রোমান্টিক চরিত্র সব খানেই যেন মানানসই। মোশাররফ করিম যেন এক তরল পদার্থ। তাঁকে যেখানেই রাখা যায়, সেখানেই তিনি নিজস্ব আকার ধারণ করেন। অভিনয় দিয়ে জাত চেনাতে সময় লাগে না। দেশ ছাড়িয়ে একের পর এক ভারতের সিনেমায় তিনি অভিনয় করে যাচ্ছেন। দুই দেশেই মোশাররফ করিমকে নিয়ে ভক্তদের মাতামাতি অন্য অভিনয়শিল্পীদের ক্ষেত্রে তেমন চোখে পড়ে না।

নাটক সিনেমার পরে যখন ওটিটির যুগ এল, তখন অনেকটাই চুপচাপ ছিলেন এই অভিনেতা। এদিকে একের পর এক ওয়েব সিরিজ, সিনেমা দর্শক গ্রহণ করছেন। কিন্তু সেখানে নেই মোশাররফ করিম। এখানেও ধৈর্য ধরলেন এই অভিনেতা। সেই আগের পথেই হাঁটলেন। সবুরে মেওয়া ফলে। অবশেষে তিনি এলেন ওসি হারুণ রূপে। এখানে বাজিমাত। ওয়েবকে নিয়ে গেলেন অন্য উচ্চতায়। দর্শক এখন তাঁকে ওসি হারুন নামে ডাকে আর অপেক্ষা করে এর তৃতীয় কিস্তি কবে আসবে। বাংলাদেশের ওয়েবে এই প্রথম কোনো ওয়েব সিরিজ দর্শকদের চাপে দ্বিতীয় কিস্তি থেকে এখন তৃতীয় কিস্তি নির্মাণ করতে হচ্ছে পরিচালক আশফাক নিপুণকে। এই পরিচালক বলেন, ‘এটা একটা রেকর্ড। ভেবেছিলাম এক কিস্তিতেই শেষ করব। এখন দর্শকদের চাপে তৃতীয় কিস্তি বানাতে হচ্ছে। দর্শক ওসি হারুণকে দেখতে চায়। আগে আমি ১০ ভাগ সতর্ক ছিলাম। এখন মহানগর–৩ নিয়ে ৫০ ভাগ সতর্ক হতে হচ্ছে। মোশাররফ করিমকে অন্যভাবে দর্শক বারবার দেখতে চান। এই সিরিজের প্রাণ তিনি। এটা প্রমাণিত।’

শেয়ার করুন

Related News

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
2627282930  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫