বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর এবার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) উপ-নির্বাচনেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সন্ত্রাসীরা ভোটের আগেই ব্যালটে সিল মারা ছাড়াও কোথা কোথাও জোরপূর্বক রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করিয়েছে। নির্বাচনের পর রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, গত ২৪ আগস্ট দেশে প্রায় ৮৪টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড সদস্য পদসহ বিভিন্ন পদে উপ-নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট গণনার শেষ মুহূর্তে পরিকল্পিতভাবে সিল মারা হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ারও ঘটনা ঘটেছে। তবে তুলনামূলকভাবে অনিয়মের ঘটনা কম হলেও ঘটনার ভয়াবহতার দিক থেকে তা উপজেলা এবং সংসদ নির্বাচনকেও ছাড়িয়ে গেছে।
সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া উপজেলা নির্বাচনের অনিয়ম, কারচুপি বেশি হলেও কোথাও আগের রাতেই ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মারার মতো ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া নির্বাচন চলাকালে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে জিম্মি করে রেজাল্ট শিটে আগাম স্বাক্ষর নেওয়ার ঘটনাও ঘটেনি।
এ অবস্থায় ইসি’র কর্মকর্তারা দিন দিন নির্বাচনী পরিস্থিতি নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২৪ আগস্ট বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নে শূন্য ঘোষিত ১নং সাধারণ ওয়ার্ড সদস্য পদে উপ-নির্বাচন ছিলো। কিন্তু এ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে রাত দেড়টা থেকে দুইটা পর্যন্ত ‘সন্ত্রাসীরা’ জিম্মি করে ফেলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তাকে।
এ নিয়ে ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এ উপ-নির্বাচন ২৪ আগস্ট, ২০১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে আনুমানিক রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে ৩০-৪০ জন সন্ত্রাসী ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে। তারা ১০টি ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে বাক্স লক করে চলে যায়। এ
সময় পুলিশের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয় বলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা লিখিত প্রতিবেদন দিয়েছেন। মোট ১ হাজার ব্যালট পেপারে সিল মারায় এবং ভোটগ্রহণ রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তিনি ওই ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করেন। ওই ভোটকেন্দ্রের নাম উত্তর একলাশপুর কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (একলাশপুর)। এখানে মোট ভোট রয়েছে ৩ হাজার ৫৬২টি।’
এদিকে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার করাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান পদে উপ-নির্বাচনে ঘটে আরো ভয়াবহ ঘটনা। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে চলে ‘জংলি’ তাণ্ডব। কেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত থাকা অবস্থায় প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার লোক ঢুকে পড়ে। এ নির্বাচনের মোট ৩টি কেন্দ্রে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। এ কেন্দ্রগুলো হলো করাদ কমিউনিটি সেন্টার, পূর্ব সিংহ গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও করাদ রহমানিয়া মাদ্রাসা।
তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে করাদ রহমানিয়া মাদ্রাসায়। এখানে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ঠিক ৫ মিনিট আগে প্রায় হাজার দেড়েক লোক ভোটকেন্দ্রে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ফোর্স ছিলেন মাত্র ৫ জন। দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই তাদের আগ্রাসী উপস্থিতি ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে।
ম্যাজিস্ট্রেট লাঠিচার্জের নির্দেশ দিলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পরে রাবার বুলেট ছোঁড়ে পুলিশ। কিন্তু ততোক্ষণে জিম্মি হয়ে যান প্রিজাইডিং কর্মকর্তা। তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে শতভাগ ভোট কাস্ট করা হয়। এরপর রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয় ‘সন্ত্রাসীরা’।
পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাওয়ার পর উপ-নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা। এ ঘটনায় মামলাও করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেছেন, নির্বাচন শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে এভাবে আক্রমণ করার ঘটনা খুবই বিরল। হয়তো তাদের আগে থেকেই এমন পরিকল্পনা ছিলো। তাই এতো লোক নিয়ে কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছে। তার বিপরীতে ফোর্সের সংখ্যা অতি নগণ্য হওয়ায় পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তবে সারাদিন শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে।
অন্যদিকে এসব ঘটনায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইসি’র বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের মতে, ইউপি নির্বাচনেই যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে সামনে সিটি কর্পোরেশনের মতো বড় নির্বাচন কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপ-সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেছেন, ইউপি নির্বাচনে অনিয়ম সংখ্যার দিক থেকে কম হলেও আক্রমণের ধরনের দিক থেকে ব্যাপক। এতে যেকোনো বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেতে পারতো।
চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও কারচুপির ঘটনা ঘটেছে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ইসি। তবে কাউকে জিম্মি করা হয়নি। বিগত দশম সংসদ নির্বাচনেও প্রায় ৩ শতাধিক ব্যাক্তি আহত হয়েছিলেন, নিহত হয়েছেন অন্তত ৪ জন।