সোমবার , ১১ই নভেম্বর, ২০২৪ , ২৬শে কার্তিক, ১৪৩১ , ৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > জাতীয় > দাফন হলো না লাশ!

দাফন হলো না লাশ!

শেয়ার করুন

আব্দুল আলীম অভি
কালিয়াকৈর ব্যুরো
গাজীপুর: কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় সরকারী বনাঞ্চল দখলকারী ভুমি দস্যু কুখ্যাত সন্ত্রাসী জসীমের গুলিবিদ্ধ লাশ কাপাসিয়া থেকে উদ্ধার করে। শুক্রবার বিকেলে জসীমের লাশ কালিয়াকৈরে নিয়ে আসলে দাফন করতে দেয়নি বিক্ষোব্ধ জনতা।

পুলিশ সূত্র জানায়, শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে কাপাসিয়ার রায়েদ ইউনিয়নের ভূলেশ^র গ্রামের নেতার টেক নামক স্থানে গজারী বন থেকে একটি বিদেশী পিস্তলসহ কাপাসিয়া থানা পুলিশ জসীমের লাশটি উদ্ধার করে। কাপাসিয়া থানা পুলিশ লাশটি ময়না তদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন। বিকেলে জসীমের স্বজনরা লাশটি গ্রহণ করে দাফনের জন্য কালিয়াকৈরের চন্দ্রা পল্লীবিদ্যুত জোড়া পাম্প এলাকায় নিয়ে আসে। এ সময় স্থানীয় হাজার হাজার বিক্ষোদ্ধ জনতার বাধার মুখে দাফন করা হলো না জসীমের লাশ। পরে নিরোপায় হয়ে জসীমের জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর এলাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়।
কাপাসিয়া থানা সূত্রে জানাযায়, শুক্রবার ভোর ৩টার দিকে থানার এসআই সুমনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ওই এলাকায় টহলরত ছিল। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে অজ্ঞাতনামা এক যুবককে একটি পিস্তলসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। এ সময় পুলিশ স্থানীয়দের সহায়তায় তাদের গ্রেফতারে এলাকায় অভিযান চালায়। পরে কাপাসিয়া থানার ওসি (অপারেশন) মনিরুজ্জামান খান ঘটনাস্থল থেকে ছাই রংয়ের প্যান্ট ও হলুদ রংয়ের শার্ট পরিহিত জসিম উদ্দীনের লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেন। তবে জসিম ইকবাল ওরফে মুচি জসীম পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নাকি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এলে কর্তব্যরত জরুরী বিভাগের চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। জসিম কালিয়াকৈরের চন্দ্রা এলাকার কুখ্যাত বনদস্যু এবং সাধারণ মানুষের কাছে আতংক হিসেবে পরিচিত ছিল।
জসীমের নিহত হবার সংবাদটি কালিয়াকৈর এলাকায় ছড়িয়ে পরলে স্থানীয় জনগণ খুশিতে মেতে উঠে। তাদের ভাষ্যমতে, দীর্ঘদিন ধরে যে অরাজকতা চালিয়ে আসছিল মুচি জসিম, মৃত্যুতে তার সা¤্রাজ্যের অবসান হলো। সেই সাথে তার ছত্রছায়ায় যারা কাজ করছিল তাদের হাত থেকেও সাধারণ মানুষ মুক্ত হলো।
উল্লেখ্য, বন ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখলসহ ক্যাডার বাহিনী দিয়ে প্রকাশ্যে কর্মকা- চালিয়ে রামরাজত্ব গড়ে তোলে জসীম।
উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের মৃত তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে জসিম ২০/২৫ বছর পূর্বে চন্দ্রা এলাকায় এসে জুতা তৈরির কারখানায় একসময় পিয়নের চাকরি করতো। সেই থেকে এলাকার মানুষের কাছে পরিচিতি ‘মুচি জসীম’ নামে। সেই জসীম ইকবাল আজ শতকোটি টাকার মালিক। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সে ছিল এক মূর্তিমান আতঙ্ক! বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ নামে এক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াতো পুলিশের এই সোর্স। ১৭টি পরোয়ানাভুক্ত মামলা মাথায় নিয়েও পুলিশের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা। সরকারী বন বিভাগের ৩০০ বিঘা জায়গা দখল করে বন কেটে গড়ে তুলেছে নতুন এক গ্রাম। টাকার বিনিময়ে চুক্তিভিত্তিক জমি জবরদখলেও সে ছিল সিদ্ধহস্ত ।
জানা যায়, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম হত্যা মামলায় পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতে গিয়ে গোটা জীবনটাই বদলে নিয়েছেন জসীম। তাঁর কাছে যেন কেউই নিরাপদ নয়। স্বার্থের পরিপন্থী হলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর হামলে পড়তো সে। একে একে ১৭টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাভুক্ত ও ২টিতে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্যেই তিনি ঘুরে বেড়াত। তাঁর কুকর্মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। বাদ যাননি সরকারি কর্মকর্তাও। ২০১৫ সালের ২১ আগস্ট চন্দ্রায় জাতির পিতা কলেজ মাঠে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে কালিয়াকৈর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলামকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর এই হত্যার ঘটনায় কপাল খুলে যায় মুচি জসীমের। রফিকুল হত্যার আসামিদের ধরিয়ে দিতে থানা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করে সে। অল্প সময়ের ব্যবধানে পুলিশের বিশ্বস্ততা অর্জনের সুযোগে হত্যা মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়ে এলাকার মানুষজনকে জিম্মি করে ফেলে জসীম। তাঁর সহযোগিতায় কালিয়াকৈর থানার পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। হত্যাকা- সম্পর্কে কিছুই জানে না এমন মানুষজনকেও ধরে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে আর জসীম মধ্যস্থতা করে তাদের ছাড়িয়ে আনে। আর থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে তিনি প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০-১৫ লাখ করে টাকা আদায় করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, চন্দ্রা এলাকায় মানুষের জমি জবরদখলে মুচি জসীমের জুড়ি মেলা ভার। লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি চুক্তিভিত্তিক জমি জবরদখল করে দিত সে। গ্রেফতারকৃত লোকজনকে প্রথমে জসিমের আস্তানায় নেওয়া হতো। সেখানে বসত গণ আদালত। জসিমের নির্ধারিত পরিমানের অর্থ পরিশোধ করলে জোড়া পাম্প এলাকা থেকেই ছেড়ে দেওয়া হতো আটককৃতদের। ওই পরিমান অর্থ দিতে অপরাগ হলে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হতো ডিবি অফিসে। মাদক মামলা ও হত্যা মামলার আসামী করার ভয় দেখিয়ে এবং শারিরীক অত্যাচার করে লাখ লাখ টাকা আদায় করে ছেড়ে দেওয়া হতো। তাছাড়া স্থানীয় লোকজনের জমি দখল এবং একজনের জমি আরেকজনকে দখল করে দেওয়ার জন্য তার আদালতেই বিচার করা হতো।
কাপাসিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক জানান, দুই দল সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে অজ্ঞাতনামা যুবকটির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ওই সন্ত্রাসীরা কারা তা এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। লাশ উদ্ধারের ঘটনায় কাপাসিয়া থানায় এসআই সুমন মিয়া বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা নং- ১১, এবং একটি অস্ত্র মামলা নং-১২ দায়ের করা হয়েছে। সকালেই লাশ ময়না তদন্তের জন্য গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।