স্পোর্টস ডেস্ক ॥
ভক্ত-সমর্থকরা আবেগতাড়িত হয়ে যতই হই চই করুক না কেন, তাকে প্রায় জোর করে জাতীয় দলে ফেরানোর আকুতিতে যতই আকাশ-বাতাস ভারী হোক- কঠিনতম সত্য হলো মোহাম্মদ আশরাফুলের আবার জাতীয় দলে ফেরা সহজ নয়।
আশরাফুল নিজেও জানেন, কাজটা কঠিন। বেশ কঠিন। পাঁচ বছরের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে তার আবার জাতীয় দলে ফেরা সহজ কম্ম নয়। শুধু তাই নয়। আশরাফুল জানেন, বোঝেন জাতীয় দলে ফিরতে হলে তাকে অনেকদূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক কিছু করে দেখাতে হবে। ফিটনেস লেভেলটা নিয়ে যেতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। পারফরমেন্সও করতে হবে সে রকম। ঘরো ক্রিকেটের সব আসরে ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতে হবে। রান করতে হবে। তবেই তার দলে ফেরার দরোজা খুলবে। অন্যথায় নয়।
সুতরাং, এ বছর প্রিমিয়ার লিগে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের হয়ে পাঁচ-পাঁচটি সেঞ্চুরির নতুন রেকর্ড স্থাপন করেও আশরাফুল বলেছিলেন, ‘আমি এখনই জাতীয় দলে ফেরার কথা ভাবছি না। ভাবার সুযোগও নেই।’
এখন প্রশ্ন হলো, আশরাফুলের আবার জাতীয় দলে ফেরার সত্যিকার মানদণ্ডটা কি? আসলে কি করলে আবার জাতীয় দলে ফিরতে পারবেন এ নন্দিত-নিন্দিত ও অসাধারণ প্রতিভাবান ক্রিকেটার? তার গায়ে আবার জাতীয় দলের ক্রিকেটারের তকমা লাগাতে কি কি প্রয়োজন? কি কি শর্ত পূরণ করলে সাদা পোশাক কিংবা লাল-সবুজ জার্সি গায়ে আবার ব্যাট হাতে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন তিনি?
মোহাম্মদ আশরাফুলের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার সময় যত ঘনিয়ে আসছে, এ কৌতুহলী প্রশ্ন ততই প্রবল হচ্ছে। ভক্ত ও সমর্থকরা যেভাবেই চিন্তা করুন না কেন? আসল ও শেষ কথা হলো বিসিবি আশরাফুল বিষয়ে কি ভাবছে? এ আলোচিত ইস্যুতে আসলে বোর্ডের মনোভাব ও অবস্থান কি?
এ সম্পর্কে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এখন পর্যন্ত সেভাবে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। নিকট অতীতে কোন বোর্ড সভায় বিষয়টি আলোচিতও হয়নি। হবেই বা কেন? বিসিবির শেষ পরিচালক পর্ষদের সভা যেদিন হয়েছে, তখনো আশরাফুলের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বেশ কিছু সময় বাকি ছিল। হয়ত আগামী বোর্ড সভায় আলোচ্য সূচিতে না থাকলেও বিষয়টি নিয়ে কথা হবে। তখন জানা যাবে আশরাফুলের বিষয়ে বিসিবির মনোভাব ও অবস্থান কি?
তা নিয়ে বোর্ডের দু’জন নীতি-নির্ধারক তথা দু’জন ডাকসাইটে পরিচালক জালাল ইউনুস এবং আকরাম খান জাগো নিউজের সাথে একদম খোলামেলা কথা বলেছেন। এছাড়া প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও আশরাফুলের ব্যাপারে জাগো নিউজকে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুস মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান। এক কথায় বোর্ডের মুখপাত্র। যে কোন বিষয়ে বোর্ডের অবস্থান ও মনোভাব তার কথাতেই ফুটে ওঠে। সে আলোকে জালাল ইউনুসের মন্তব্য মানেই বোর্ডের বক্তব্য।
অন্যদিকে জাতীয় দল পরিচালনা, পরিচর্যা এবং তত্ত্বাবধানের সমুদয় দায়-দায়িত্ব যে স্ট্যান্ডিং কমিটির ওপর ন্যাস্ত, সেই ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটি প্রধান আকরাম খান। আর মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর মুখের কথা যে টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদেরও মনোভাব-মানসিকতার কণ্ঠ দলিল।
তাদের তিনজনের কথা শুনে মনে হলো, খুব ইতিবাচক না হলেও আশরাফুল ইস্যুতে বিসিবি মোটেই নেতিবাচক নয়। তারা আগে-পরে আরও কিছু বিষয়কে মানদণ্ড ভাবছেন। বিবেচনায়ও আনতে চাচ্ছেন। তবে সবার প্রথম ও শেষ কথা হলো, আশরাফুলের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়নি। ফিটনেস লেভেলটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালে আর ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফর্ম করতে পারলে অবশ্যই আশরাফুল বিবেচনায় চলে আসবে।
ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান জাগো নিউজের সাথে আলাপে অনেক কথা বলেছেন। তবে শুরুতেই বলে নিয়েছেন, আমার বক্তব্যটি একান্তই আমার নিজের বোধ-অনুভব ও উপলব্ধির। বোর্ডের নয়।
আকরাম বলেন, ‘আশরাফুল ইস্যুতে ক্রিকেট বোর্ডের চিন্তা ভাবনা কি, বোর্ড তাকে নিয়ে আসলে কি ভাবছে, তা আমি এখনই বলতে পারব না। কারণ এটি বোর্ডের নীতি নির্ধারণী বিষয়। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সাথে যুক্ত কোনো ক্রিকেটারের উপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর তাকে নেয়া বা না নেয়ার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট ক্রিকেট বোর্ডের। এটা অবশ্যই স্পর্শকাতর বিষয়। কাজেই আশরাফুল ইস্যুতে বোর্ডের অবস্থান কি, তা আসলে আমার জানা নেই। এটা হয়তো আলোচনা সাপেক্ষে জানা যাবে এবং নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর হয়তো সেই আলোচনাটা নিশ্চয়ই বোর্ডের নীতি নির্ধারণী মহলেই হবে। তখনই বিসিবির চিন্তা-ভাবনা ও মনোভাব পরিষ্কারভাবে জানা যাবে। তবে একজন ক্রিকেটার ও জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হিসেবে আমি মনে করি, আশরাফুলের দরজা খোলা আছে বা থাকার কথা।’
আকরাম আরও বলেন, তুষার ইমরান যদি মধ্য তিরিশে গিয়েও ‘এ’ দলে ডাক পেতে পারে, তবে আশরাফুল কেন পাবে না? সে যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার মতো শারীরিক সক্ষমতা দেখাতে পারে এবং ঘরের ক্রিকেটে খুব ভালো পারফর্ম করে, তাহলে হয়তো তাকে বিবেচনায় আনা হতেও পারে। সন্দেহ নেই, আশরাফুল অনেক মেধাবী ব্যাটসম্যান। দেশকে কিছু ম্যাচ সে একাই জিতিয়েছে। তার আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা আছে, সে জানে কখন কি করতে হবে। যার প্রমাণও সে দিয়েছে। এর পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক বিষয়ই আছে, সেটাতো সবারই জানা। এখন বিষয়টা অনেকটা আশরাফুলের উপর। সে যদি ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব বেশি ভালো খেলে, তাহলে তার কথা হয়তো টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচকদের ভাবতে হবে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু বলার অবস্থা নেই।’
অন্যদিকে মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস জানান, ‘এখন তো আর আশরাফুলের নাম দেখে জাতীয় দলে ডাকার, নেবার কোন সুযোগ বা অবস্থা নেই। একমাত্র ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে ডোমেস্টিক ক্রিকেটের পারফরমেন্স ও ফিটনেস। তার পারফরমেন্সটাই হবে আসল বিবেচনা।’
ঘরোয়া নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর সে ডোমেস্টিক খেলছে। কার্যত এক বছর, দুটি প্রিমিয়ার লিগ। আমার মনে হয় সেটা নতুন করে জাতীয় দলে ফেরার জন্য যথেষ্ঠ নয়। এরপরে যদি সে অমন কিছু আহামরি পারফরম করে, তাহলে নির্বাচকদের মনে ধরলে তাকে নেবে। উল্লেখযোগ্য পারফর্ম করলে নির্বাচকদের ব্যাপার। তবে নিতেই হবে এমন কথা নেই। তার ফিটনেস লেভেল এবং পারফরমেন্সের গ্রাফ ওপরে থাকলেই কেবল সে বিবেচনায় আসতে পারে।’
ওপরের কথাগুলোর সাথে আরও একটি বিষয়ের কথা জোর দিয়ে বললেন জালাল ইউনুস। তার ব্যাখ্যা, ‘আশরাফুল নিজেই স্বীকার করেছে, সে বিপিএলসহ বেশ কিছু ম্যাচে পাতানো খেলায় অংশ নিয়েছে। যত স্বীকারোক্তিই দিক, আর যে কয় বছর নিষেধাজ্ঞার কবলেই কাটাক না কেন, আসল কথা হলো সে নৈতিকভাবে অবশ্যই দূর্বল আছে। দলে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে। সময় লাগবে। তা থেকেই যাবে। তা কাটানো কঠিন।
জালাল ইউনুসের শেষ কথা, ‘অর্থাৎ, শুধু খেলার পারফরমেন্স আর ফিটনেস ভাল থাকাই নয়। আশরাফুলের ওপর টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসাটাও কিন্তু খুব জরুরি।’
ওদিকে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর সোজা সাপটা কথা, ‘এখন আশরাফুলকে নিয়ে কোন চিন্তা ভাবনা নাই। নিষেধাজ্ঞা উঠলেই তাকে নিতে হবে- এমন তো কোন কথা নেই। আগে নিষেধাজ্ঞা উঠুক, খেলুক। তারপর ওকে দেখবো। অনেকদিন জাতীয় দল তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেই। ঘরের ক্রিকেটের সাথে যেটার মানের ফারাক বিস্তর। ওর ফিটনেস লেভেলটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট উপযোগী হতে হবে। পারফরমেন্সটাও হতে হবে তেমন। তার পর হয়ত আগে ‘এ’ দলে দেখতে হবে। শেষ কথা ও আগে টপ লেভেলে ভাল পারফর্ম করুক, তারপর বিবেচনা করে দেখা হবে। তার আগে প্রশ্নই আসে না।’