স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে। গ্রিড ইন্টারকানেকশন বিট্যুইন বাংলাদেশ (ভেড়ামারা) অ্যান্ড ইন্ডিয়া (বহরমপুর) নামের এই প্রকল্পের ব্যয় শেষ মুহূর্তে অযৌক্তিকভাবে ৫০১ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের আগেই প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করে কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে বহু বিতর্কিত ও বাংলাদেশ সরকারের কালো তালিকাভুক্ত সিমেন্সকে। আর পরিকল্পনা কমিশনকে পাস কাটিয়ে ‘উপরের চাপ আছে’ এমন কথা বলে একনেক সভায় প্রকল্পটি ঘটনা-উত্তর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যদিও কোনো প্রকল্প েেত্রই ঘটনা-উত্তর অনুমোদনের বিধান নেই। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যুৎ বিনিময়ের এ প্রকল্পটি বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বাস্তবায়ন করছে। হঠাৎ করেই গত জানুয়ারি মাসে পিজিসিবি প্রকল্প ব্যয় ৫০১ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা করতে পরিকল্পনা কমিশনে সংশোধিত প্রস্তাব পাঠায়। এর আগে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে একনেকে অনুমোদন হওয়া এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা। প্রকল্পের এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৭০০ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। প্রকল্পটি ওই বছরের জুলাই থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত ২ বছরে বাস্তবায়নের কথা ছিল। ২০১২ সালের জুন মাসে ব্যয় না বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত একবার বাড়ানো হয়। সূত্র আরো জানায়, গত ১০ জানুয়ারি সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রকল্পের ব্যয় ৫০১ কোটি টাকা বা ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হলেও কাজের পরিধি বৃদ্ধি পায়নি। প্রকল্পটি সংশোধন না করেই এই বর্ধিত মূল্যে বাংলাদেশ সরকারের কালো তালিকাভুক্ত জার্মান প্রতিষ্ঠান সিমেন্সকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়, যা নিয়মবহির্ভূত। ঘটনা-উত্তর প্রকল্প সংশোধনের কোনো নিয়ম নেই। অন্যদিকে প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ব্যয় বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা বর্তমান বাজারদর অপো অনেক বেশি। মাত্র ৩১০ মিটার রাস্তা নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। প্রকল্পের সিডি-ভ্যাট বাবদ ব্যয় ১০৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৬৬ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে। এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধির হার ১৫০ শতাংশ। সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এইচএস-কোড একটি হারমোনাইজড কোড এবং এতে প্রযোজ্য সব আইটেমের সিডি-ভ্যাটের হার পূর্ব থেকেই নির্ধারিত রয়েছে। হঠাৎ একটি প্রকল্পের জন্য সিডি-ভ্যাট বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
জানা গেছে, প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় ব্যয় বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের যুগ্ম প্রধানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে কমিশনের বিদ্যুৎ উইং, কার্যক্রম বিভাগ, আইএমইডি ও পিজিসিবির কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কমিটি চারটি বৈঠক ও গত ৯ ফেব্রুয়ারি প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বিবেচনা করার সুযোগ না দিয়ে উপরের মহল থেকে চাপ সৃষ্টি করে সংশোধিত প্রকল্পটি অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়।
সিমেন্সকে ঘিরে বির্তকিত হচ্ছে মহাজোট সরকারও : সিমেন্সকে কাজ দিয়ে বির্তকিত হতে যাচ্ছে মহাজোট সরকারও। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দিয়ে সরকারি কাজ পাওয়ার দায়ে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কালো তালিকভুক্ত হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কাছে প্রতিষ্ঠানটি স্বীকার করেছে ২০০১-২০০৬ এ সময়ে বাংলাদেশে প্রভাবশালীদের কমপে ৫৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ ডলার ঘুষ দিয়েছে তারা।
এখন ভারত থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সঞ্চালন লাইন নির্মাণের মূল কাজটি পেয়েছে সিমেন্স। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ট্রান্সমিশন লাইন ও সাব-স্টেশন যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যয় ৪৭৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৪৮ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর ২৭০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের ডিপিপি সংশোধন না করেই এরই মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিমেন্স জার্মানির সঙ্গে চুক্তি সই করেছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পরিচালক দু’জনেই পরিকল্পনা কমিশনের কাছে দাবি করেছেন, টাকার মূল্যমান পড়ে যাওয়ায় ব্যয় বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ডলারের বিপরীতে টাকা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ছিল ৮৪ টাকা ১০ পয়সা। আর প্রকল্পটি সংশোধন করে অনুমোদন করিয়ে নেয়ার সময় গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতি ডলারের বিপরীতে টাকার দর ছিল ৭৯ টাকা। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পটির কার্যক্রম আগের চেয়ে কিছুটা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার টাকার অবস্থান শক্তিশালী হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে বেশি অর্থ ব্যয় হওয়ার কথা নয়। ফলে প্রকল্পটির বিপরীতে মোট ৫০১ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবটি যৌক্তিক নয়।
এ কারণে প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়া আটকে দিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগ। শিল্প ও শক্তি বিভাগ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কাছে সন্দেহ হওয়ায় প্রকল্পটির অনুমোদন প্রক্রিয়া স্থগিত রেখে অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তাদের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় একনেক সভায় প্রস্তাবটি চূড়ান্ত অনুমোদনের বিষয়টি স্থগিত করে আমরা ব্যয় বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে একটি তদন্ত দল গঠন করি। কিন্তু তদন্ত দলের প্রতিবেদন প্রস্তুত হওয়ার পরও সেটি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বরং নিয়ম ভঙ্গ করে প্রকল্পটি ঘটনা-উত্তর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ‘উপরের চাপ আছে, বাড়তি ব্যয় অনুমোদন না করলে অন্যত্র বদলি করে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়।’ এই কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ মত কাজ করলে প্রকল্পের সরকারি অংশের ব্যয় অন্তত ৮০ কোটি টাকা কমানো যেত।