রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > রাজনৈতিক সহিংসতার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছে গান পাউডার

রাজনৈতিক সহিংসতার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠছে গান পাউডার

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজনৈতিক সহিংসতায় মরণঘাতী গান পাউডারের ব্যবহার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একের পর এক গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষ। দেশের বাজারে এই বিস্ফোরক দ্রব্যের বাণিজ্যিক সরবরাহ না থাকলেও নাশকতাকারীরা যেন হাত বাড়ালেই পেয়ে যাচ্ছে গান পাউডার। সীমান্ত গলিয়ে অবৈধ পথে আসা এসব গান পাউডারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে নানামুখী বক্তব্য।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গান পাউডার প্রকাশ্যে বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন উৎস থেকে তা সংগ্রহ করছে। গান পাউডার হচ্ছে প্রাচীনতম পদ্ধতির উচ্চ মতাসম্পন্ন একটি বিস্ফোরক। নিকট অতীতে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন হামলায় গান পাউডার জাতীয় বিস্ফোরক ব্যাবহার করেছে। সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও বোমা কিংবা ককটেল তৈরির উপকরণ হিসেবে গান পাউডার ব্যবহার করে।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয় দলের প্রধান অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন জানান, বাংলাদেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বৈধভাবে গান পাউডার আমদানি করা হয়। কিছু অসাধু আমদানিকারক বৈধ পথে নিয়ে আসা গান পাউডার তুলে দিচ্ছে দুর্বৃত্তদের হাতে। তিনি জানান, পটকা, আতশবাজি, গুলি তৈরির মতো বিভিন্ন কাজে গান পাউডার ব্যবহৃত হয়। গান পাউডার খুব দ্রুত জ্বলে। এটি কোনো কিছুর বিস্ফোরণকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া অবৈধ পথেও গান পাউডার দেশে প্রবেশ করছে বলে জানান তিনি।

তবে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক জিয়াউল আহসান জানান, দেশে গান পাউডারের বাণিজ্যিক কোনো ব্যবহার নেই। অবৈধ পথে এগুলো দেশে প্রবেশ করছে। দুর্বৃত্তরা সেভাবেই এসব পাউডার সংগ্রহ করছে। তবে কোন দেশ থেকে এগুলো আসছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।

দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে গান পাউডার ব্যবহার করে মানুষ পুড়িয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে। গত কয়েক বছরে এর ব্যবহারের মাত্রা অনিয়মিত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশে গান পাউডারের প্রথম অপব্যবহার কবে বা কারা শুরু করেছিল এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির প্রথম গান পাউডার ব্যবহার করে বলে অসমর্থিত একটি সূত্রে জানা যায়।

চলতি বছরের ৫-৬ মে রাজধানীতে হেফাজতের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় বিশেষ করে বায়তুল মোকাররম মসজিদ সংলগ্ন দোকানগুলোতে যে আগুন দেয়া হয় সেখানেও গান পাউডার ব্যবহার করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

সাম্প্রতিক সময়ে হরতালে কমলাপুর রেলস্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেন উপকূল এক্সপ্রেসের পেছনের কয়েকটি বগি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক সাংবাদিকেদের জানান, ‘যাত্রীবেশে ট্রেনে উঠে গান পাউডার ব্যবহার করে নাশকতা চালিয়েছে জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা।’

২০১০ সালে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর গ্রামে একটি বাড়ির দরজা-জানালা বাইরে থেকে আটকে ভেতরে গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় একই পরিবারের ১১ সদস্যকে। সেই বিভীষিকার কথা এখনো ভোলেননি ওই গ্রামের মানুষ।

গত ৭ মার্চ হরতালের আগের দিন ফরিদপুর সদরে হানিফ পরিবহনের একটি বাস গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এত আহত হন ১২ বাস যাত্রী।

সর্বশেষ গত ১৯ সেপ্টেম্বর জামায়াতের ডাকা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের দ্বিতীয় দিন গাজীপুরে একটি যাত্রীবাহী বাসে গান পাউডারের আগুন দিয়ে জামায়াত-শিবির কর্মীরা পুড়িয়ে মারে বাসটির মালিক ও চালক নজরুল ইসলামকে।

২০০৪ সালে রাজধানীর হোটেল রূপসী বাংলার (তৎকালীন শেরাটন) সামনে একটি দোতলা বাস গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ওই ঘটনায় ১১ যাত্রী ঘটনাস্থলেই জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান। অভিযোগ আছে তৎকালীন যুবলীগের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

গত বছরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কোরান অবমাননার জের ধরে কক্সবাজারের রামু, উখিয়া ও টেকনাফের বৌদ্ধবিহার ও পল্লীতে যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় সেখানেও গান পাউডার জাতীয় বিস্ফোরক ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা জানিয়েছেন, এই গান পাউডারে সূত্র ধরে এগিয়ে গেলে এই সহিংসতার প্রকৃত রহস্য ও ইন্ধনদাতাদের খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। প্রশিতি কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এ হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।

আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে কিছু গান পাউডার উদ্ধার করলেও পরিমাণে সেগুলো খুবই সামান্য।

গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মহানগরীতে র‌্যাব-৫ যাত্রীবাহী একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করে ৪ কেজি গান পাউডার ও ৩০টি ককটেল। ধারণা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে উদ্ধারকৃত গান পাউডারের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় চালান।

এর আগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বাসাবো থেকে র‌্যাব ৩-এর একটি দল ককটেল তৈরির বিভিন্ন উপাদানসহ উদ্ধার করে ২০ গ্রাম গান পাউডার।

আদিকথা : সহযোগী একটি পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর পূর্বে চীনারা প্রথম আতশবাজির সঙ্গে গান পাউডার ব্যবহার করে। চীনারা প্রথম আতশবাজি তৈরি করে নবম শতকে। প্রচলিত একটি গল্প থেকে জানা যায়, একজন চীনা পাচক (বাবুর্চি) ভুলবশত তিনটি রান্নার উপাদান একসঙ্গে মিশিয়ে উচ্চতাপমাত্রায় রাঁধতে গিয়ে বিস্ফোরণের শিকার হন এবং সেই থেকে আজকের দিনের গান পাউডারের প্রাথমিক উপকরণের সন্ধান পায় চীনারা।