বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের (রসিক) ভোটে জয় হল জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার। এই প্রথম দলীয় প্রতীকের ভোটে সদ্য বিদায়ী মেয়র ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে আনেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। বেসরকারি ফলাফল অনুযায়ী ১৯৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৩৩টি কেন্দ্রে মোস্তফা পান ১,৬০,৪৮৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রংপুর সিটি কর্পোরেশনের (রসিক) সাবেক মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু পান ৬২,৪০০ ভোট। বিএনপির প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা ৩৫,১৩৬ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। নির্বাচনে মোট সাতজন মেয়র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
জাপার বিদ্রোহী প্রার্থী হাতি প্রতীকে আসিফ শাহরিয়ার ২ হাজার ৩১৯, ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা মার্কায় গোলাম মোস্তফা বাবু ২৪ হাজার ৬ ভোট, বাসদের আব্দুল কুদ্দুছ মই মার্কায় ১ হাজার ২৬০ এবং এনপিপির সেলিম আক্তার আম মার্কা পেয়েছে ৮১১ ভোট। অর্থাৎ নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৯৮ হাজার ৮৯ ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচত হন মোস্তফা। গতকাল দিনভর উৎসব-আমেজে ভোট শেষে রংপুর পুলিশ কমিউনিটি মিলনায়তনে তা গণনা করা হয়। ৩ লাখ ৯৩ হাজার ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। যদিও গত সিটি নির্বাচনে পড়েছিল ৭৮ দশমিক ৭০ শতাংশ।
শীতের শিশিরভেজা সকালে উৎসবমুখর পরিবেশে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। নগরীর ৩৩ ওয়ার্ডের ১৯৩ কেন্দ্রের এক হাজার ১২২টি বুথে ভোটাররা তাদের রায় দেন। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর কিংবা অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, শীতের মধ্যেও ভোটারদের উপস্থিতি ছিল বেশ ভালো। তবে এবারের নির্বাচনে পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারীই ছিল বেশি। নগরীর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের ভোটার নজরুল ইসলাম মনু ও সফিকুল ইসলাম মুকু জানান, পাঁচ বছর পর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরে খুব আনন্দ লাগছে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর শিশুমঙ্গল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দেন জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। এ সময় তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ভালোভাবে ভোটগ্রহণ হলে তার প্রার্থী এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবেন।
এর আগে সকাল সোয়া ৯টার দিকে নগরীর আলমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ভোট দেন জাপা প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। সাড়ে ৯টার দিকে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু সালেমা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ভোট দেন। বিএনপি প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা ভোট দেন মাহিগঞ্জের দেওয়ানটুলি স্কুলে। দুপুর ১২টার পর সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু বলেন, ভোটে এখনো কোনো কারচুপির অভিযোগ পাইনি। ফল যাই হোক তা মেনে নেব।
৪ বছর পর ইভিএমে ভোট
প্রায় চার বছর পর ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট দেওয়ার আয়োজন করল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪১ নম্বর কেন্দ্র সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজে ইভিএমে নিজেদের রায় জানান ভোটাররা। এই কেন্দ্রে জয়ী হন লাঙল প্রতীকের মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। আগের দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইভিএম নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেও তেমন কোনো বিপত্তি ছাড়াই এ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়। তবে বেলা ১১টার দিকে দুটি মেশিনে কিছুটা ত্রুটি দেখা দেয়। এ কারণে প্রায় ১০ মিনিট বুথ দুটিতে ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। এরপরও ইভিএমে ভোট দিয়ে খুশি রসিকবাসী।
কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আজহারুল ইসলাম বলেন, ইভিএমে ভোটগ্রহণে কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। ভোটাররাও ভোট দিয়ে খুশি। তবে দুটি মেশিনে অল্প সময়ের জন্য সমস্যা দেখা দিলেও দ্রুত তা ঠিক করা হয়।
নিউ শালবনবাসী সাহিদা খানম বলেন এই প্রথম ইভিএমে ভোট দিলাম, খুব ভালো লাগল। এ পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ নিরাপদ ও সহজ। এতে জালভোট দেওয়ার সুযোগ নেই বলেও মনে করেন ষাটোর্ধ্ব এই নারী ভোটার। কারিমা স্বপ্না বলেন, আগে সিল মারার ঝামেলা ছিল, সিল অন্য জয়গায় পড়লে ভোট নষ্ট হতো। এখন সেই ঝামেলা নেই।
এদিকে ২০১৩ সালে কাজী রকিব কমিশনের অধীনে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি নির্বাচনে ১৩টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হওয়ার পর ইসি-বুয়েট দ্বন্দ্বে বন্ধ হয়ে যায় এ যন্ত্র নিয়ে এগোনোর কাজ। পরে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সহযোগিতায় বর্তমান ইসির নিজস্ব উদ্যোগে তৈরি নতুন ইভিএমের প্রথম পরীক্ষা করা হলো রসিকে। রংপুরে গত সিটি নির্বাচনেও তিনটি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হয়েছিল।
ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রেও শান্তির বার্তা
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত দেশের সিটি, পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা ও ভোট কারচুপির অভিযোগ থাকলেও রসিক নির্বাচন ব্যতিক্রম। ১৯৩ কেন্দ্রের ১০৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। প্রায় ২০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত এই সিটি নির্বাচনে কোনো সহিংসতা কিংবা ভোট কারচুপির নির্দিষ্ট অভিযোগ করেননি কোনো মেয়র কিংবা কাউন্সিলর প্রার্থী।
২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার অ্যাডভোকেট জাহিদুল ইসলাম বলেন, রংপুরবাসী শান্তিপ্রিয়। দেশের অন্য জায়গায় ভোটে যাই ঘটুক, এখানে কোনো সহিংসতার খবর পাবেন না বলেই আমার বিশ্বাস। সবাই আনন্দমুখর পরিবেশে ভোট দিয়ে পছন্দের প্রার্থী নির্বাচন করেছেন।
জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা মনে করেন, কেবল রংপুরেই নয়, সারা দেশেই লাঙ্গলের জোয়ার বইছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জয়ের এই ধারা শুরু হল রংপুর দিয়েই। তারা বলছেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দেশবাসী এমনিভাবে লাঙ্গলের বিজয় দেখতে পাবে। রংপুর দিয়েই এর আগে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ শেষে শুরু হয় ভোট গণনা।
২০১২ সালে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্দলীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু মোটরসাইকেল প্রতীকে ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা হাঁস নিয়ে পেয়েছিলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। আর বিএনপির কাওসার জামান বাবলা আনারস প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৩৫ ভোট। তখন ভোটার ছিল ৩ লাখ ৫৭ হাজার। ভোট দিয়েছিলেন ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোটার। এবার সিটি নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮৯৪ জন। মেয়র পদে সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ ছাড়া ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ২১১ এবং ১১টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ৬৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
সূত্র : আমাদের সময়