শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > শীর্ষ খবর > সংকটের শেষ নেই রোহিঙ্গা শিবিরে > চাল আছে তো ডাল নেই, ডাল আছে তো তেল নেই

সংকটের শেষ নেই রোহিঙ্গা শিবিরে > চাল আছে তো ডাল নেই, ডাল আছে তো তেল নেই

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
রোহিঙ্গা শিবিরে হাজারো সংকট। চাল আছে তো ডাল নেই। ডাল আছে তো তেল নেই। আবার চাল, ডাল, তেল সংগ্রহ করতে পারলেও নেই কোনো লাকড়ি। গতকাল দিনভর অঝোর ধারায় বৃষ্টি ছিল উখিয়ার রোহিঙ্গা পল্লীতে। কাদা, পানি আর বৃষ্টিতে ভিজে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো ত্রাণের বস্তায় দেখা গেছে, চাল-ডাল, তেল আছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে চুলা বন্ধ। দিনভর বৃষ্টি থাকায় সকাল ও দুপুরে অনেক রোহিঙ্গা না খেয়ে থেকেছেন। তারা অপেক্ষায় ছিলেন বিকালে চুলা জ্বলবে। কিন্তু তাও হয়নি। বিকালেও কক্সবাজারজুড়েই ছিল বৃষ্টি। কোনো কোনো তাঁবুতে দেখা যায়, বাচ্চারা কান্নাকাটি করছে। পেটে ক্ষুধার পাশাপাশি সর্দিজ্বরে আক্রান্ত এসব শিশু। গতকাল উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালীসহ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। তাঁবুগুলোতে দেখা যায়, নানা রকম সমস্যা আর দুর্ভোগ। ত্রাণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। চালু হয়নি কোনো রেশনিং পদ্ধতি। খেটে খাওয়া মানুষগুলো দ্রুত ফিরতে চায় তাদের দেশে। টানা অভাব-অনটনের মুখে পড়ার আগেই তারা মিয়ানমারে গিয়ে স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনযাপন শুরু করতে উন্মুখ হয়ে আছেন।

রোহিঙ্গা পল্লীর সার্বিক সমস্যা প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, ‘আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি, যতদিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থাকবে, তাদের থাকা-খাওয়াসহ সব সমস্যা দূর করতে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে। প্রতিদিন অন্তত ৫০০ মেট্রিক টন খাদ্য আমরা তাঁবুগুলোতে বিতরণ করছি। বিভিন্ন স্থানে মেডিকেল ক্যাম্প বসিয়ে চিকিৎসাসেবাও দেওয়া হচ্ছে। চেষ্টার কোনো ত্রুটি নেই। ’ মিয়ানমারের মংডু, বুছিদং, রাছিদং থেকে আসা সোনা মিয়া, মোহাম্মদ হোসেন, সাইদুল হক, আবদুল মজিদ, আনোয়ারা বেগম, উম্মে হাবিবা, নূর মোহাম্মদ, মো. একরাম, রাবেয়া বশরী, হালিমা খাতুন— এদের প্রত্যেকের প্রায় একই কথা, মিয়ানমারে মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছি। এখানে সেই ভয় নেই। তবে তাঁবুতে আছে অনেক কষ্ট। নিজেরা কষ্ট করছি তাতে সমস্যা নেই।

কিন্তু বাচ্চারা যখন খাওয়ার অভাবে কান্নাকাটি করে, নানা অসুখে কাঁদে তখন কষ্ট আরও বেড়ে যায়। তারা আরও জানান, ‘বাঁচার অধিকার পেলে আমরা তো মিয়ানমারে ফিরে যেতেই চাই। মুসলিম রোহিঙ্গা হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের জন্য মিয়ানমারে স্বাধীনভাবে থাকার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করে মগ-মুসলিম পরখ না করে সমঅধিকারে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। মিয়ানমারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত চলাফেরার সুযোগ থাকতে হবে। ’ রাছিদংয়ের ঝুপারাং থেকে আসা রোহিঙ্গা সোনা মিয়াকে (৪৫) থাইংখালীর অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ছোট্ট একটি তাঁবুতে বসে থাকতে দেখা গেছে। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি। তাঁবুর একদিক দিয়ে ভিতরে পড়ছে বৃষ্টির পানি। বৃদ্ধা অসুস্থ মা, স্ত্রী আর চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে অলস বসে আছেন সোনা মিয়া। তাঁবুর এক পাশে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। ঘরের এক কোণে দুই কেজি পরিমাণ আলু ও তিন-চারটি পিয়াজও দেখা যায়। বেলা তখন সোয়া ২টা।

দুপুরের খাবার হয়েছে কিনা, নাকি রান্নার প্রস্তুতি শুরু হবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুপুরে কেউই খাই না, সকালে কোনোরকম খেয়েছি আবার খাব রাত নামলে। তিন বেলা খাওয়ার মতো চাল-ডাল নেই। ১৫ দিন হলো এখানে এসেছি। বিশ্বাসযোগ্য না হলেও সত্য— ত্রাণ পেয়েছি মাত্র একবার। ’ কুতুপালংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পে কথা হয় মিয়ানমারের ভুছিদং থেকে আসা আজিমুদ্দীনের সঙ্গে। বললেন, ‘আমরা এখনো কোনো সরকারি ত্রাণকার্ড পাইনি। তাই মাঝিদের দেওয়া ত্রাণকার্ড দিয়ে গত ২০ দিনে মাত্র দুবার ত্রাণ পেয়েছি। পরিবারের আটজনকে নিয়ে কোনোমতে দিন কাটাচ্ছি। নতুন কোনো ত্রাণ না পেলে দুই দিন পর থেকে উপোষ থাকতে হবে। ’ থাইংখালীর একটি পাহাড়ের চূড়ায় পরিবারের সাত সদস্যকে নিয়ে একটি তাঁবুতে থাকেন নূর মোহাম্মদ। মিয়ানমারের রাছিদং থেকে আসা মধ্য বয়সী এই রোহিঙ্গার তাঁবুতে গিয়ে দেখা যায়— তার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনজনই অসুস্থ। তারা সবাই জ্বর ও সর্দি কাশিতে ভুগছে। অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিয়েছেন। তারপরও দুই দিন ধরে জ্বর কমছে না।

নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের একদিকে খাবার সংকট, অন্যদিকে চলছে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ সংকট। নোংরা পরিবেশে থেকে সব বাচ্চা এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সামনে আরও কী কষ্ট ভোগ করতে হবে জানি না। ’ থাইংখালীর একই পাহাড়ে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়া আরেক রোহিঙ্গা আবদুল মজিদের সঙ্গে কথা হয় তার তাঁবুর বাইরে। বেলা তখন দেড়টা। আবদুল মজিদ বসেছিলেন তাঁবুর এক কোনায় কাপড়চোপড়ের বস্তার সঙ্গে হেলান দিয়ে। তার পাঁচ ছেলেমেয়ে তখন দুপুরের খাবার থালা নিয়ে বসা। চারদিকে তখন মাছির ভন ভন আওয়াজ। দুর্গন্ধও নাকে লাগছে বেশ। খাবারের পাতে দেখা গেল সাদা ভাত আর আলু ভর্তা। তাদের সামনে রয়েছে এক বাটি সবজিও। বাইরে ডেকে নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি কী জানতে চাইলে আবদুল মজিদ বলেন, ‘প্রধান সমস্যা থাকা আর খাওয়া। বৃষ্টি হলে রাতে সবাই একসঙ্গে ঘুমাতে পারি না। তাঁবুর চারপাশ থেকে পানি চুপসে মেঝে ভিজে যায়। তখন ছোট শিশুদের ঘুমাতে দিয়ে আমরা বসে থাকি। আর ত্রাণের ওপরই আমাদের একমাত্র ভরসা। ত্রাণ সহযোগিতা না পেলে আমাদের একদিনও চলবে না। ’

উলুবনিয়া সীমান্তে ফের রোহিঙ্গা স্রোত : টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে গতকাল অনুপ্রবেশকালে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে আটকে দিয়েছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)। মিয়ানমারের নাইচাদং ও কুয়াংচিদং সীমান্ত দিয়ে তারা বিকাল ৪টা থেকে বাংলাদেশের উলুবনিয়া সীমান্ত হয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় বিজিবি বাধা দিলে তারা সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান নেয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ করে বিকাল ৪টা থেকে সীমান্তে রোহিঙ্গা স্রোত নামে। খবর পেয়ে বিজিবির সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টাকালে রোহিঙ্গাদের কর্ডন করে রাখে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করতে না পেরে তারা নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান নেয়। রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা নোম্যান্স ল্যান্ডেই অবস্থান করছিলেন।

দুই রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার, নিখোঁজ ৩০ : কক্সবাজারের টেকনাফে নাফ নদে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনায় শিশুসহ দুজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আরও অন্তত ৩০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। গতকাল রাতে নাফ নদের গোলারচর পয়েন্টে এ দুর্ঘটনা ঘটে। বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, রাত ১০টার দিকে গোলারচর পয়েন্টে মিয়ানমারের দিক থেকে আসা রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা ডুবে যায়। ঘটনার কিছু সময় পর আটজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে এক শিশু ও বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে টেকনাফ থানার ওসি মাইনুদ্দিন জানান। বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আরও বলেন, ‘উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, নৌকাটিতে ৪০ জনের মতো নারী, পুরুষ ও শিশু ছিল। ভাটার সময় দমকা হাওয়ার কারণে নৌকাটি উল্টে এ ঘটনা ঘটে।

অন্তত ৩০ জন রোহিঙ্গা নিখোঁজ রয়েছে। ’ নিখোঁজদের সন্ধানে বিজিবির সদস্যরা কাজ করছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন