শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > জাতীয় > ফরহাদ মজহারের দাসী অর্চনা রানীকে পাওয়া যাচ্ছে না

ফরহাদ মজহারের দাসী অর্চনা রানীকে পাওয়া যাচ্ছে না

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
উদ্ধারের পর দিন ঢাকার আদালতে জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার অন্তর্ধানের বিষয়ে যা বলেছেন, তার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের পর এখন অর্চনা রানির বক্তব্যের সঙ্গে নিজেদের তদন্তে মিল পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। তবে জবানবন্দি দেয়ার পর অর্চনা নিরুদ্দেশ। ঠিকানায় তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্তের মিল-অমিল তথ্য সম্পর্কিত আরও কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুুলিশ এখন ফরহাদ মজহারের সুস্থ হয়ে ওঠার অপেক্ষায় আছে।

গত ৩ জুলাই সকালে নিখোঁজ হওয়ার ১৮ ঘণ্টা পর নাটকীয়ভাবে যশোরে বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করে র‌্যাব-পুলিশ। পরদিন ঢাকায় আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তাকে অপহরণ করে খুলনায় নেওয়া হয়েছিল। ফরহাদ মজহার অন্তর্ধান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সব মহলে আলোচনার মধ্যে ‘তদন্তের সূত্র ধরে’ গত ১০ জুলাই ঢাকার আদালতে অর্চনা রানি নামে এক নারীকে নিয়ে আসে পুলিশ। নিজেকে ফরহাদ মজহারের শিষ্য দাবি করে এই নারী জবানবন্দিতে বলেন, সেদিন ফরহাদ মজহার তার জন্য অর্থ জোগাড় করতেই বেরিয়েছিলেন এবং টাকাও পাঠিয়েছিলেন। আদালতে দেওয়া অর্চনা রানির বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এ নিয়ে ফরহাদ মজহারের সমালোচনা যেমন উঠেছে, তেমনি নাটক সাজানো হচ্ছে বলেও ডানপন্থি এই অধিকারকর্মীর সমর্থকরা দাবি করছেন। পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্কের মধ্যে কথা বলা হলে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতারের করা অপহরণ মামলার তদন্তের তদারককারী কর্মকর্তা হাফিজ আল আসাদ বুধবার জানিয়েছেন, ‘ফরহাদ মজহারের ঘটনায় এক নারীর আদালতে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে পুলিশের তদন্তে পাওয়া তথ্যে মিল পাওয়া যাচ্ছে।’

গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার হাফিজের এই বক্তব্য আসার আগে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ফরহাদ মজহার আদালতে যে তথ্য দিয়েছেন তার সঙ্গে তদন্তের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের সময়ই অপহরণের অভিযোগ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সেদিন বিকালে খুলনা নিউ মার্কেটে ফরহাদ মজহারের একাকী ঘোরাফেরার একটি ভিডিও পুলিশের হাতে আসার পর সেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে বলে জানান ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এই অপহরণ নিয়ে অত্যন্ত রহস্য তৈরি হয়েছে। কারণ ফরহাদ মজহার সাহেব বিজ্ঞ আদালতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যে ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি, সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছি, কল লিস্ট পেয়েছি, বস্তুগত সাক্ষ্য প্রমাণ পেয়েছি, তার সঙ্গে উনার বক্তব্যের মিল নেই।’

অর্চনা রানিসহ পুলিশের নানা বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার বলেছেন, ‘এটা নিয়ে আমরা কোনো কথা বলব না।’

৪ জুলাই জবানবন্দি দেওয়ার পর থেকে ঢাকার শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে রয়েছেন ৭০ বছর বয়সী ফরহাদ মজহার। তার স্ত্রী ফরিদাও রয়েছেন স্বামীর সঙ্গে। জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেছিলেন, ওষুধ কেনার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হলে কয়েকজন একটি মাইক্রোবাসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরে খুলনায় নিয়ে ছেড়ে দেয়। নিরুদ্দেশ অবস্থায় ফরহাদ মজহার স্ত্রী ফরিদাকে ফোন করে মুক্তিপণের অর্থ নিয়েও কথা বলেছিলেন। ওই রাতে যশোরে বাসে খোঁজ পাওয়ার আগে খুলনা নিউ মার্কেট এলাকার ‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক আব্দুল মান্নান দাবি করেন, তার রেস্তোরাঁয় ফরহাদ মজহার রাতে ভাত খেয়েছিলেন। খুলনার এই রেস্তোরাঁয় ফরহাদ মজহারকে দেখা গেছে বলে দাবি করেন এর মালিক আব্দুল মান্নান। শিববাড়িতে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার ব্যবস্থাপক নাজমুস সাদাত সাদী আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, ফরহাদ মজহার সেদিন তার কাউন্টার থেকে ‘গফুর’ নামে টিকেট কেটে বাসে উঠেছিলেন। ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ বলেন, ‘ফরহাদ মজহারের কাছে কোনো টাকা থাকত না। ওই নারীকে সহায়তার জন্য তিনি স্ত্রীর থেকে টাকা আদায়ের কৌশল হিসেবে অপহরণের কথা বলে থাকতে পারেন।’

গত নয় দিনের তদন্তে যেসব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, সেসবের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান বলেছেন, ‘কংক্রিট সিদ্ধান্তে আসার জন্য আমাদের আরও দু-একদিন সময় লাগবে। সংবাদ সম্মেলন করে এই নিয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’

জবানবন্দিতে যা বলেছিলেন অর্চনা :

নিজেকে বাউলভক্ত ফরহাদ মজহারের ‘ভক্ত’ ও ‘সেবাদাসী’ দাবি করে তাকে ‘গুরুদেব’ সম্বোধন করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন অর্চনা। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তার বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া। বাবা শংকর কুমার মিত্রের সঙ্গে ঝগড়ার কারণে তিনি ২০০৫ সালের শেষ দিকে মামার বাড়ি চলে যান। ২০০৬-০৭ সালের মাঝামাঝি ফরহাদ মজহারের এনজিও উবিনীগে যোগ দেন। উবিনীগের কক্সবাজার শাখায় থাকার সময় ফরহাদ মজহারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। এরপর ফরহাদ মজহারের কাছে ‘ফকির ও বৈষ্ণব আদর্শে’ দীক্ষা নেওয়ার পর তার ‘সেবাদাসী’ হন বলে এই নারী জানান। ঈশ্বরদীতে থাকার সময়ে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বলে দাবি করেন এই নারী। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে সেই সম্পর্ক ফরিদা আখতার জেনে ফেলার পর তাকে উবিনীগ থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। তবে ফরহাদ মজহার তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন ও টাকা দিয়ে সহায়তা করতেন।

এই নারী জবানবন্দিতে বলেন, ‘একাধিকবার শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার পর প্রায় দুই বছর আগে তিনি অন্তঃস্বত্বা হলে ফরহাদ মজহারের টাকায় তিনি মালিবাগের একটি ক্লিনিকে গর্ভপাত করিয়েছিলেন। সেখানে সব ধরনের আর্থিক সহায়তা ফরহাদ মজহার করেছিলেন।’ আবার ‘গর্ভবতী’ হলে গত এপ্রিল মাসে তিনি ফরহাদ মজহারের কাছে টাকা চেয়েছিলেন জানিয়ে অর্চনা বলেছেন, তার কাছে টাকা না থাকায় ‘চিন্তিত ছিলেন ফরহাদ মজহার’।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘০৩/০৭/২০১৭ ইং তারিখ সকাল ৬টা ২০ মিনিটে গুরুবাবা ফোন করে আমাকে জানান, তোমার টাকা সংগ্রহের জন্য বাহির হয়েছি। চিন্তা করো না। ০৩/০৭/১৭ ইং তারিখ সকাল ১১টায় আমি গুরুবাবাকে মোবাইল ফোনে জিজ্ঞাসা করি, আপনি অপহৃত হয়েছেন কি না? তিনি আমাকে বলেন, কোনও সমস্যা নাই। আমি ভালো আছি। ‘এরপর সন্ধ্যা ৭টার দিকে গুরুবাবা আমাকে মোবাইল করে একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর চান। তখন আমি তাকে অ্যাকাউন্ট নম্বর পাঠাই। তিনি আমাকে দুটি নম্বর থেকে ১৫ হাজার টাকা পাঠান। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করেন, টাকা পেয়েছি কিনা? আমি বাসায় এসে মোবাইল ফোন চেক করে টাকা পাওয়ার কথা জানাই।’ নিখোঁজ হওয়ার দিন ফরহাদ মজহারের সঙ্গে ৫-৬ বার এবং তার আগের দিন ২-৩ বার টেলিফোনে কথা হয়েছিল বলে দাবি করেন অর্চনা। অর্চনা রানি এখন গর্ভবতী নন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা হাফিজ।

অর্চনা এখন কোথায়?

গত ১০ জুলাই ঢাকার আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার পর নিরুদ্দেশ অর্চনা, তার কোনো ঠিকানায় তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রাঙ্গুনিয়া থেকে নিয়ে এলেও এখন পুলিশ কর্মকর্তারাও তার কোনো খবর জানেন না বলে দাবি করেছেন। জবানবন্দিতে অর্চনা বলেছেন, ৪ জুলাই চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার গিয়েছিলেন তিনি। ৯ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে ঢাকা নিয়ে আসেন। পরে বাসা থেকে মোবাইল ফোন ও একটি ডায়েরি নিয়ে যায় পুলিশ। রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি ইমতিয়াজ ভূঁইয়া গণমাধ্যমের এক জিজ্ঞাসায় বলেন, ‘সেদিন রাতে ঢাকা থেকে পুলিশ এসে পারুয়া ইউনিয়নের হাজারীহাট বাজারে এক আতœীয়ের বাসা থেকে ওই নারীকে নিয়ে যান। এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।’

ডিবি কর্মকর্তা হাফিজ বলেন, ‘ফরহাদ মজহারের মোবাইলের কললিস্ট দেখে এক নারীর নম্বর পাওয়া যায়। তার সঙ্গে তিনি একাধিকবার কথা বলেছিলেন। পরে গোয়েন্দারা ওই নারীকে ঢাকায় নিয়ে আসে।’ জবানবন্দি দেওয়ার পর ফরহাদ মজহারকে নিজের জিম্মায় বাড়ি ফিরতে অনুমতি দিয়েছিল আদালত। অর্চনাও জবানবন্দি দেওয়ার পর নিজের বাড়িতে চলে যান বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ‘তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখেনি’, বলেন ডিবির সহকারী কমিশনার হাফিজ।

ফরহাদ মজহার ঢাকায় আনার পর আদাবর থানায় ফরহাদ মজহার ঢাকায় আনার পর আদাবর থানায় জবানবন্দিতে নিজের ঠিকানায় ঢাকার ভাটারা থানা এলাকার নতুন বাজারের নুরের চালার একটি বাড়ির ঠিকানা দিয়েছেন অর্চনা। কিন্তু অসম্পূর্ণ ওই ঠিকানা ধরে তার বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায়নি। জবানবন্দিতে অর্চনা ভাটারা এলাকায় ভাত বিক্রি করেন বলে উল্লেখ করেছেন। ওই পুরো এলাকা ঘিরে এই নামে কোনো ভাত বিক্রেতার খবর পাওয়া যায়নি।

দীপালি নামে এক ভাত বিক্রেতা বলেন, এই এলাকায় তিনি ছাড়া আর কোনো হিন্দু নারী ভাত বিক্রি করেন না। ভাটারা থানার ওসি নুরুল মুত্তাকীম বলেন, অর্চনা রানি নামের কোনো ভাত বিক্রেতার খবর তারও জানা নেই। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় খোঁজ নিয়েও অর্চনার সন্ধান মেলেনি। আমরাগাছিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাখালী গ্রামে শংকর কুমার মিত্রের মেয়ে অর্চনা এলাকা থেকে দীর্ঘদিন ধরে বাইরে থাকেন বলে স্থানীয়রা জানান। আমরাগাছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিল ফরাজী বলেন, ‘তার বাবা অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় আছে। দীর্ঘ দিন পরপর অর্চনা এলাকায় এসে তার বাবার খোঁজ-খবর নিয়ে আবার চলে যায়। আমরা জানি যে সে ঢাকায় চাকরি করে।’ মঠবাড়িয়া থানার ওসি কে এম তারিকুল ইসলাম বলেন, অর্চনা সম্পর্কে ‘তেমন কিছু জানা নেই’ তার। বিডি নিউজ