শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > শীর্ষ খবর > থামছে না খাদ্যে ভেজাল

থামছে না খাদ্যে ভেজাল

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
ভেজাল পণ্য। নোংরা পরিবেশ। নেই অনুমোদন। নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্যের লেভেল লাগিয়ে ভেজাল পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। বাজার, দোকান, সুপারশপ কোথাও ভেজালমুক্ত খাদ্যপণ্য মিলছে না। মাছেও ফরমালিন, দুধেও ফরমালিন। ফল-ফলাদিতে দেওয়া হচ্ছে কার্বাইডসহ নানা বিষাক্ত কেমিক্যাল। খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশানোটা রীতিমতো অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভেজালের বেপরোয়া দাপটের মধ্যে আসল পণ্য খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর। ভেজাল পণ্যের দাপট ঠেকাতে চলছে অভিযান। করা হচ্ছে জেল-জরিমানা। কিন্তু বন্ধই করা যাচ্ছে না খাদ্যে ভেজাল। জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে ভেজাল আর নকলের সীমাহীন দৌরাত্ম্য। অতিমাত্রায় কীটনাশক, কেমিক্যাল আর রঙের আধিক্যতায় বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেমিক্যাল আর পিয়াজের রস মিশিয়ে তৈরি করা হয় খাঁটি সরিষার তেল। দুধের মধ্যে রাসায়নিক কেমিক্যাল ফরমালিন, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড, বোরিক অ্যাসিড, স্যালিসাইলিক, ইউরিয়া, চিনি, লবণ, সোডিয়াম বেনজোয়েট, সোডিয়াম কার্বনেট, ফ্লেভার, ক্ষতিকর রং, আলকাতরা, আটা, ময়দা, ভাতের মাড়, শ্বেতসার ও স্কিম মিল্ক পাউডার মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে গাভীর খাঁটি দুধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরমালিন উচ্চমাত্রার বিষাক্ত পদার্থ, এর কারণে দ্রুত কিডনি নষ্ট, ক্যান্সার, লিভার ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুদের হার্টের রোগ ও দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। গর্ভজাত মায়ের শিশুও বিকলাঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। শাকসবজিতে রাসায়নিক কীটনাশক, জিলাপি-চানাচুরে মবিল। ব্রেড, বিস্কুট, সেমাই, নুডলসসহ সবরকম মিষ্টিতে টেক্সটাইল-লেদারের রং, মুড়িতে ইউরিয়া-হাইড্রোজেনের অবাধ ব্যবহার চলছে। চাল, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, আলু থেকে শুরু করে রুটি, কেক, মিষ্টি, বিস্কুট কিছুই ভেজালের ছোবল থেকে বাদ যাচ্ছে না। জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে জরুরি ‘পানি’ পর্যন্ত নিরাপদ থাকছে না।

কলা, আম, পেঁপে, পেয়ারা, আনারস থেকে শুরু করে আপেল, আঙ্গুর, নাশপাতিসহ দেশি-বিদেশি প্রায় সব ফলেই মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল। অপরিপক্ব ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ও তা উজ্জ্বল বর্ণে রূপান্তরের জন্য অধিক ক্ষার জাতীয় টেক্সটাইল রং ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। জানা গেছে, ফল গাছে থাকা পর্যায় থেকে বাজারে বিক্রির মুহূর্ত পর্যন্ত একেকটি ফলে ছয় দফা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মূলত গ্যাস জাতীয় ইথাইলিন ও হরমোন জাতীয় ইথরিল অতিমাত্রায় স্প্রে করে এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করার কারণেই ফলগুলো রীতিমতো বিষে পরিণত হয়। ব্যবসায়ীদের দাবি, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই ফলমূলে ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো হয়। রমজানের শুরুতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা এবং জনসাধারণের কেনাকাটায় নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে নিয়মিত অভিযান শুরু করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ভেজাল পণ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে বিএসটিআই, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), এপিবিএন-৫ ও ঢাকা জেলা প্রশাসন যৌথভাবে অভিযান চালাচ্ছে। ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মশিউর রহমান জানান, অভিযানের সংখ্যা বাড়ছে। বেড়েছে ভেজালকারীর সংখ্যাও। বিভিন্ন অভিযানে তাদের জেল-জরিমানা করা হলেও ভেজাল পণ্যের দৌরাত্ম্য কমছে না। ভেজাল ঠেকাতে সচেতনতার বিকল্প নেই। আইন দিয়ে ভেজাল ঠেকানো সম্ভব নয়।
এ জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ এলাহী বলেন, ভেজালবিরোধী অভিযানে ফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে। নিয়মিত অভিযান ও গণমাধ্যমের সুবাধে অনেকের মধ্যে সচেতনতা এসেছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রি এবং বাজারজাত করার চেষ্টা করছে। তাদের সন্ধান পেলেই অভিযান চালানো হচ্ছে। করা হচ্ছে জেল-জরিমানা।
কৃষিবিদ এবং চিকিৎসকরা বলছেন, ফল ব্যবসায়ীরা সাধারণত যেসব নিম্নমানের কার্বাইড ব্যবহার করেন তা থেকে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিক তৈরি হয়। এই আর্সেনিক বা সেঁকো বিষই ফলের মধ্যে থেকে যায় এবং মানবশরীরে প্রবেশ করে। নানা রাসায়নিক পদার্থযুক্ত বিষময় ফল ধীরে ধীরে মানুষের লিভার ও কিডনি অকেজো করে দেয়। হার্টকে দুর্বল করে, ব্রেনকে ন্যুব্জ করে, কমে যায় স্মৃতিশক্তিও। অস্বাভাবিকভাবে অ্যাসিডিটি বাড়ায়। ফরমালিনযুক্ত খাদ্য নিয়মিত গ্রহণের ফলে পাকস্থলী, ফুসফুস ও শ্বাসনালিতে ক্যান্সার, এমনকি ব্লাড ক্যান্সারও হতে পারে। মহাখালী পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল ও দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত হয়। সারা দেশ থেকে স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের পাঠানো খাদ্য দ্রব্যাদি পরীক্ষাকালে এ তথ্য বেরিয়ে আসে।
কিন্তু সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরীক্ষাগারের এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলছেন, রাজধানীতে বাজারজাত হওয়া খাদ্যপণ্যের অন্তত ৭৯ ভাগই ভেজাল। এসব খাদ্যদ্রব্য মৌসুমের আগেই বিক্রি ও তা দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল মেশানো হয়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এক গবেষণায় বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। পরিবেশ বাঁচাও-এর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলছেন, বিষাক্ত খাদ্যপণ্য রোধ করা না গেলে শিগগিরই দেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ১০ থেকে ১২ ভাগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন