স্টাফ রিপোর্টার ॥
আসছে বিরাট ব্যয়ের ‘নির্বাচনী’ বাজেট। এবারের বাজেটে সামাজিক উন্নয়ন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দিকেও বেশি নজর দেয়া হচ্ছে।
সবমিলিয়ে আগামী বাজেটে সরকার একদিকে যেমন জনতুষ্টির চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে মধুর একটি সম্পর্ক তৈরির রূপরেখা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। যা চলমান উন্নয়ন আরও সামনের দিকে নিয়ে যাবে। এ জন্য অগ্রসরমান অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বিশাল বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
যেহেতু সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনী বৈতরণী পারের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের এবারের প্রস্তাবিত বাজেট জনবান্ধব হবে- এমনটি মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১ জুন) জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। যার শিরোনাম দেয়া হচ্ছে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’।
এবারের বাজেটে রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে দুই লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। বিশাল এ বাজেটে ঘাটতিও এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জনপ্রত্যাশা পূরণের চেষ্টাই থাকবে এ বাজেটে।
বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের জন্য বরাদ্দ বাড়ানোসহ বেশকিছু জনবান্ধব উদ্যোগের ঘোষণা দেবেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট ঘোষণার আগে সব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে নতুন ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আইন বাস্তবায়নের ইস্যুটি। ব্যবসায়ী ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিপরীতমুখী অবস্থান রয়েছে এ ইস্যুতে। বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছেন।
এছাড়া ব্যাংকে স্থায়ী আমানতে ওপর আবগারি শুল্ক প্রায় দ্বিগুণ হওয়ার খবরটিও এখন আলোচনায়। ব্যাংকের সুদের হার কমে যাওয়ার পর নতুন করে আবগারি শুল্ক আরোপের খবরে উদ্বেগের মধ্যে আছেন ব্যাংকে আমানতকারীরা।
বর্তমানে সঙ্কুচিত ভিত্তিমূল্যে কিংবা ট্যারিফ মূল্যের ভিত্তিতে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট দেয়া বেশকিছু পণ্য ও সেবাকে ভ্যাট অব্যাহতি দিতে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যমান ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত খাতের সঙ্গে শেষ সময়ে এসে কৃষি, খাদ্য, শিক্ষাসহ আরও দুই শতাধিক পণ্য ও সেবা ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। বিশেষত যেসব খাতের কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এমন বেশকিছু খাত ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় আসতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, ১৭০টি পণ্য বাদে বাকি এক হাজার ৩৪৯টি আমদানিকৃত পণ্যের ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসছে সরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনমনে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা কাটছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বের ১৬০টি দেশে ভ্যাট কার্যকর আছে। এর মধ্যে হাতে গোণা কয়টি দেশ বাদে সব দেশেই ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কার্যত ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এটি সম্ভব নয়। ফলে একধরনের সংকট তৈরি হবে।
এছাড়া ব্যাংকে আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক দ্বিগুণ হচ্ছে। ২০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর দেড়শ টাকার স্থলে দুইশ টাকা দিতে হবে। তবে এক লাখ টাকার ওপর থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর বিদ্যমান পাঁচশ টাকার স্থলে এক হাজার টাকা গুণতে হবে। ১০ লাখ টাকার ওপরে ও এক কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর দেড় হাজার টাকার স্থলে তিন হাজার টাকা, এক কোটির ওপরে ও পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর সাড়ে সাত হাজার টাকার স্থলে ১৫ হাজার টাকা, পাঁচ কোটি টাকার ওপরে যেকোনো পরিমাণ অর্থের ক্ষেত্রে ১৫ হাজার টাকার স্থলে ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছিল।
আসন্ন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ঘোষণা করা হবে চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট। বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হবে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ভর্তুকি বাবদ থাকছে নয় হাজার কোটি টাকা। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন এবং সরকার কয়েক দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন অর্থবছরে ভর্তুকির পেছনে সরকারের অর্থ খরচ কম হবে।
প্রবৃদ্ধির হার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭ দশমিক ৪ শতাংশের লক্ষ্য থাকছে বাজেটে। সাময়িক হিসাবে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছর লক্ষ্য ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৪ ভাগ হয়েছে প্রবৃদ্ধি। আসছে বাজেটে বৈদেশিক ঋণ এবং অনুদানের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ থাকবে। সঞ্চয় উৎসাহিত এবং পেনশনারদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আপাতত সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো হচ্ছে না। তবে বাজেটের পরে কমানোর ঘোষণা আসবে। জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে।
এডিপির আকার ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। আসছে নতুন অর্থবছরে মেগা প্রকল্পগুলো দৃশ্যমান হওয়া শুরু করবে। এ জন্য জাতীয় অগ্রাধিকার বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখে নতুন অর্থবছরের এডিপির আকার চূড়ান্ত করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ফাস্ট ট্র্যাকের প্রকল্প সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে এবারের বাজেটে। এজন্য চলমান আট মেগা প্রকল্পের জন্য ৩৩ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত নতুন বাজেট ঘাটতি হবে মোট দেশজ উৎপাদনের (ডিজিপি) ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেটে ঘাটতি রয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী বছর তা ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।
সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বাড়ানো হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দও বাড়ছে। মাসিক ভাতার পরিমাণ একশ থেকে দুইশ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বছরে দুটি উৎসব ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত আসছে বাজেটে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে।