বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
সেনা সমর্থিত ওয়ান ইলেভেনের সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার এফআইআর তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ জায়গায়। আর মামলা করার জন্য এফআইআর তৈরিতে আলাদা করে নেওয়া হয়েছিল আইনজীবীও। তারা দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলার এফআইআর তৈরি করেছেন। দুই নেত্রীর এফআইআর তৈরিতে আলাদা আলাদা আইনজীবীর প্যানেল ছিল। দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলার এফআইআর এমনভাবে তৈরি করার জন্য বলা হয়েছিল যাতে করে কোন নেত্রী মামলার ফাঁক গলে বেরিয়ে না যান। আর এটাও বলা হয়েছিল দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা কম বেশি করা যাবে না। তা সমান সংখ্যক হতে হবে। সেই হিসাবে সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা সংখ্যা সমান হয়নি। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছয় মামলা আর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আরও মামলার এফআইআর তৈরি করা হলেও সেগুলো আর মামলা দায়ের করা হয়নি।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য এবং এফআইআর তৈরি করার জন্য রাজি ছিল না গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটি। ওই সময়ে ঘটনার অনুসন্ধান শেষে এফআইআর তৈরি করে, তা সমন্বয় কমিটির বৈঠকে অনুমোদন দিলে এরপর মামলা হতো। সেখানে সমন্বয় কমিটিকে সহায়তা করতো দুদকের আইনজীবী প্যানেলের সিনিয়র আইনজীবীরা।
দুর্নীতি, ক্ষমতার অপ্যবহার ও অবৈধ্যভাবে সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগে প্রথমে ৪২০ জনের তালিকা করলেও সেই তালিকায় শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার নাম ছিল না। যদিও পরে আর ৪২০ জনের পুরো তালিকা প্রকাশ হয়নি। প্রকাশ হয়েছে ২২২ জনের নাম। গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটির তরফ থেকে ওই সময়ের সরকারকে বলা হয়েছিল তারা খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার নাম কোন ভাবেই দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ্যভাবে সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগে তালিকা প্রকাশ করতে পারবেন না। এই কারণে তারা তালিকা প্রকাশ করেনি। যেই কারণে তাদের তালিকায় ওই দুইজনের নাম নেই। পরে বিশেষ জায়গা থেকে ওই দুইজনের নামে আলাদা করে তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে কেবল দুইজনেরই নাম ছিল। সেটি বিশেষ তালিকা ছিল।
সূত্র জানায়, যেখানে তাদের মামলার এফআইআর তৈরি করা হয়েছিল তাদের কাছে দুই নেত্রীর ব্যাপারে তথ্য ছিল ও নথিপত্র ছিল। সেখানে তারা অনেক আগে থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন। আর ওয়ান ইলেভেনের অনেক পরে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর সেই হিসাবে ওই সব আইনজীবীরা কাজ করেছেন। গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটিতে খালেদা জিয়ার একজন আতœীয় দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ছিলেন এর ঘোর বিরোধি। তার কারণে দ্ইু নেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না। তিনি কোন ভাবেই শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার এফআইআর তার দপ্তর থেকে করাতে রাজি হননি। রাজি না হওয়ার কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় করা হয়।
ওই সময়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা ও তাদেরকে গ্রেফতার করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেনা কর্মকর্তারা এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেননি। বরং সিদ্ধান্ত হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের নিয়ে বৈঠকে। বিশেষ বৈঠক হয়েছিল। সেখানে উপদেষ্টারা ছাড়াও ওই সময়ের সেনাপ্রধান, গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী, আরও সেনা কর্মকর্তরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার ও তাদেরকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে প্রধান সমন্বয়কারী আপত্তি তুলে বলেছিলেন, দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ রয়েছে তা আইনী বিচারে ঠিক না। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। এছাড়া তিনি এও বলেছিলেন এক নেত্রীর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা টিকতে পারে। তবে একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে এনিয়ে জনগণের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। এতে করে সরকারের ভাবমুর্তিও ক্ষুন্ন হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করা যাবে না। তাদেরকে গ্রেফতার করা হলে সমস্যা বাড়বে। কারণ শেষ পর্যন্ত সমাধান হবে না। সমঝেতা করতে হবে। কারণ এখনও তাদেরকে মাইনাস করার পরিস্থিতি এদেশে নেই। তাই বিষয়টি ভেবেই নিতে হবে।
সূত্র জানায়. ওই বৈঠকে তার আপত্তি থাকলেও পরে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়। যদিও আগাগোড়াই ওই সময়ে সব কিছুই শেখ হাসিনার বেলায় আগে করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে আগে ও আবার গ্রেফতার করা হয়েছে আগে। তাকে যখন গ্রেফতার করা হয়েছিল তখন গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটির প্রধানকে একটি কাজে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার পরও চেষ্টা ছিল খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তিনি রাজি ছিলেন না। অনেক চেষ্টা করা হয় পাঠানোর। সৌদি দূতাবাসে বিশেষ সূত্রে অভিযোগ করা হয় তাকে জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওই তথ্য পাওয়ার পর এই জন্য তারা বলে দেয় বেগম খালেদা জিয়া নিজে আবেদন না করলে ভিসা দিবেন না। যদিও তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সব প্রস্তুতি সম্পূর্ন করা হয়েছিল। র্যাবের যে কর্মকর্তাকে দিয়ে তাকে বিমানবন্দরে নিরাপদে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাকেই আর খালেদা জিয়ার আতœীয় বলে দিয়েছিলেন কোন ভাবেই যেন তাকে বিদেশে পাঠানো সম্ভব না হয়। রাতভর এনিয়ে অনেক নাটকও হয়েছে।
খালেদা জিয়া বিদেশে যেতে না চাওয়ায় পরে তার নামে মামলা হতে থাকে। তাকে যখন গ্রেফতার করা হয় ওই সময়ে ওই সেনা কর্মকর্তা দেশে ছিলেন না। তাকে বিদেশে পাঠানো হয়। বিদেশে বসেই তিনি জানতে পারেন তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গুরুত্বর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটির অফিস ছিল ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোন নথিপত্র ছিল না। ছিল না কোন এফআইআরও। ওইগুলো ছিল বিশেষ অফিসে। যারা সব সময় ও প্রতিনিয়ত খবর রাখেন দেশের কোথায় কি হচ্ছে? সেই হিসাবে তারা ধারাবাহিকভাবেই সব খবর পাচ্ছিল কখন কোন কোন প্রকল্প কোন কোন মাধ্যমে কেমন করে হচ্ছে? এই কারণে যখন ওয়ান ইলেভেনের পরিকল্পনা করা হয় তখন থেকেই দেশে বিদেশে দুই নেত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সকলের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাদের যাবতীয় সম্পদ, সম্পত্তি, ব্যাংক হিসাব, তাদের টাকা বেনামে কারো কাছে আছে এমন সব বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করেন। সেই হিসাবে তাদের কাছে অনেক তথ্য ও উপাত্ত ছিল। দুই নেত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন সব নেতাদের নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদেও অনেক তথ্য পান। ব্যবসায়ীরাও অনেক তথ্য দেন। তথ্য সংগ্রহ করার পর নথি জোগাড় করা হয়। ব্যবসায়ীদের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করতে সাহায্য করলে ও তথ্য এবং নথিপ্রমাণ দিলে তাদের কোন সমস্যা হবে না। সেই নিশ্চয়তা পেয়েই ব্যবসায়ীরা সহায়তা করেন। চাঁদাবাজির মামলার তথ্য সংগ্রহ করা ওয়ান ইলেভেনের পর। আর তখন সব তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করে মামলা হয়। সব নথি সংগ্রহ করার পর সেই হিসাবে দেশের ছয়জন আইনজীবীদের নিয়ে তিন জন তিনজন করে দুটি প্যানেল করা হয়। ওই প্যানেলের আইনজীবীরা দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর তৈরি করেন। পরিকল্পনা ছিল আরও যেসব তথ্য উপাত্ত আছে সেগুলোর ভিত্তিতে মামলা দায়ের করার। সেই হিসাবে যেগুলো মামলা হয়েছে এর বাইরেও আরও এফআইআর তৈরি করা হয়েছিল।
সূত্র জানায়, ওই সময়ের সরকার একমত হয়েছিল দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে। সেনা কর্মকর্তাদের উপর তারা একেকভাবে দোষ চাপানোর কথা কেউ কেউ বললেও প্রকৃত পক্ষে দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে তখন কোন উপদেষ্টা আপত্তি করেননি। তারাও চেয়েছেন দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সেই হিসাবে সম্মতি দেন। সেনা কর্মকর্তারা যে সিদ্ধান্ত নিতেন এর বিরুদ্ধে কোন উপদেষ্টা অবস্থানও নেননি।
উল্লেখ, বিবিসি বাংলার সাপ্তাহিক আয়োজন ‘এ সপ্তাহের সাক্ষাৎকার’ অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেছেন, তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তারা রাজনীতিবিদদের ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিলেন। একটা জিনিস আমি এখন বলতেছি আপনাকে, সেটা আপনি ভেরিফাই (যাচাই) করেন সাংবাদিক হিসেবে, দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছে, এ মামলাগুলোর কাগজপত্র আগে থেকেই তৈরি ছিল। নাইনটি-নাইন পার্সেন্ট। একটা হয়তো হইতে পারে .. একমাত্র ঐ যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাস্টের একটা ব্যাপার নিয়ে। ঐটা মনে হয় তারা নতুন করেছে.. সেটা ভিন্ন কথা। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির অভিযোগে চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তৎকালীন সেনা কর্মকর্তাদের মনোভাব উল্লেখ করে মইনুল হোসেন বলেছেন, তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নিতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, তাদের (সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের) একটা বক্তব্য ছিল যে ব্যারিস্টার সাহেব আমরা তো বেশি দিন থাকবো না, কিন্তু একটা শিক্ষা দেয়া উচিত যে নো বডি ইজ অ্যাভাব ল ( কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।) সে প্রাইম মিনিস্টার হোক আর প্রেসিডেন্ট হোক। সে হিসেবে তাদের একটা অ্যাটিটিউড কাজ করছে। এটা আমি অস্বীকার করবো না।
বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ করেছে, একটা ধারণা রয়েছে যে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাসহ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং তাদের গ্রেফতারের পেছনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন।
মইনুল হোসেন বলেন, যেহেতু আমি সে সময় রাজনীতি নিয়ে কথা বলতাম ৃ তারা (রাজনীতিবিদরা) মনে করেছে যেহেতু দুর্নীতির মামলা হচ্ছে সেটা ব্যারিস্টার সাহেব করতেছে। আই ওয়াজ সিরিয়াসলি মিসআন্ডারস্টুড (আমাকে সাংঘাতিক রকম ভুল বোঝা হয়েছিল)। আমাকে টার্গেট করা হয়েছিল।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, যেদিন ওয়ানইলেভেন করা হয়েছে সেদিন দুপুরের আগে জেনারেল মইন জানতেন না তারা ওই রকম একটি সরকার করবেন। বরং দুপুরে ক্রোড় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সিদ্ধান্ত আসে নতুন। দুপুরে তারা বৈঠক করার পরই সিদ্ধান্ত নেন রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার। সেই হিসাবে জেনারেল মঈনের পেটের পীড়া থাকা সত্ত্বেও তিনি বঙ্গভবনে সবাইকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেই তারা রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে সব করান। তবে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে কি কি করাবেন সেটা আগেই তৈরি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তখনও কোন মামলার এফআইআর তৈরি করা হয়নি। আমাদের সময়.কম