শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > রাজনীতি > আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে, তবু মেয়র পদে হেরেছে কেন?

আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে, তবু মেয়র পদে হেরেছে কেন?

শেয়ার করুন

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী ॥
গত ৩০মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন (কুসিক) অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ১১ হাজারের কিছু বেশি ভোটে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীর কাছে হেরেছেন। এবার স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হওয়ায় দল ও জোট সমর্থকদের ভোট প্রতীকের দিকে বেশি পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, স্থানীয় বিষয়ে নানা বিচার বিবেচনাতেও ভোটারদের অনেকে ভিন্ন প্রতীকে ভোট দিয়ে থাকেন- এমনটি অস্বীকার করার উপায় নেই। কুমিল্লার ভোটের হিসাবে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ মনোনীত সকল পদের প্রার্থীগণের মোট ভোট বিএনপির মেয়র এবং পরাজিত ও বিজয়ী প্রার্থীদের ভোটের চাইতে বেশি। তারপরও আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা ১১ হাজারের কিছু বেশি ভোটে বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে গেছেন। এর সহজ উত্তর হচ্ছে সীমা নৌকা প্রতীকে সম্ভাব্য সকল ভোটারের ভোট টানতে পারেন নি। যদি ওই ১১ হাজার ভোট তার বাক্সে যুক্ত হতো তাহলে আওয়ামী লীগের মোট ভোটের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। অন্যদিকে দ্বিতীয় বার নির্বাচিত বিএনপির মেয়র মনিরুল হক সাক্কু ২০১২ সালের চাইতে মাত্র তিন হাজার ভোট বেশি দলীয় প্রতীকে টানতে পেরেছেন। ২০১২ সালের সেই নির্বাচনে সীমার পিতা কুমিল্লা আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল খান উক্ত নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ছিলেন, প্রায় ২৮ হাজার ভোটে আফজাল খান উক্ত নির্বাচনে সাক্কুর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। সেই তুলনায় তার মেয়ে সীমা আওয়ামী লীগের প্রতীকে ২১ হাজারের বেশি ভোট বাড়াতে পেরেছেন। তারপরও হারার কারণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বেশির ভাগ খবর ও মতামতের সুর প্রায় অভিন্ন। এতে দলীয় কোন্দলকে আঞ্জুম সীমার পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি অংশত ঠিক তবে প্রার্থীর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা যেকোনো নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখে। এর নজির নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে দেখা যেতে পারে। ২০১২ সালে উক্ত নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীর জয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল হালে মোটেও পানি পায় নি, গেল নির্বাচনেও কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। কুমিল্লার আওয়ামী রাজনীতিতে আফজাল- বাহার দ্বন্দ্ব চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে বলে সবাই জানেন। তারপরেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাহার সাহেব বিএনপির প্রার্থীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয়লাভ করেছেন। ২০১৪ এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ছিলেন বাহারউদ্দিন। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হলেন আফজাল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ। তখন বাহার সাহেব উক্ত নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আফজাল খান ১৯৮৩ সাল থেকে বেশ কবারই কুমিল্লায় নির্বাচন করেছেন, কিন্তু কোনো বারই তিনি জয়লাভ করতে পারেন নি। সেই তুলনায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাহারউদ্দিন নির্বাচনে জয় পেয়েছেন অনেক বেশি। ভোটারের কাছে প্রার্থী হিসেবে তাদের মূল্যায়ন কিন্তু এক রকম নয়। আঞ্জুম সীমা আগের সব নির্বাচনে জয়লাভ করলেও এবার মেয়র পদে হেরেছেন। নিজের চাইতেও তার পিতা এবং ভাইদের প্রতি সংখ্যালঘু পরিবারে ভোটার ছাড়াও অন্য অনেকের মধ্যেই ভয়ভীতি ব্যাপকভাবে কাজ করেছিল। সে ধরণের অনেকেই ভোট দানে বিরত ছিলেন, অনেকেই নেগেটিভ ভোট দান করেছেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সীমার পিতা এবং ভাইদের প্রতি বেশ কিছু ভোটারের কোনো কালেই আস্থা ছিল না। ফলে এই সময়ে যখন আওয়ামী লীগের প্রতি কুমিল্লার সাধারণ ভোটারের উৎরে যেতে পারেন নি- এটি নিশ্চিত। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিষযগুলো আগে থেকে নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে অন্য কোনো ভাবমূর্তি সম্পন্ন প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদান করলে মেয়র পদে বিপরীত চিত্র দেখার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল। তবে কুসিক নির্বাচনে বিএনপি মেয়র পদে জয়লাভ করলেও ভোটের হিসাবে ততটা ভালো অবস্থানে নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটিকে ক্যাশ করতে পারে নি, বিএনপির ঘরে ভোটের ক্যাশ বাক্স চলে গেছে, তাতে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বুকে কিছুটা হলেও রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের ভোট বেশি থাকা সত্তেও অনেকবারই ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে এটিই বাস্তবতা। ভবিষ্যতে এ সব বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন প্রদান এবং দলকে তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কতটা সেভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটিই দেখার বিষয়।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়