স্টাফ রিপোর্টার ॥
ঢাকা: ট্যানারি স্থানান্তরে সরকারি নির্দেশনা এড়াতে ট্যানারি মালিকরা নতুন বায়না ধরছে বলে মনে করছেন সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ট্যানারি মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ৩১ মার্চের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর না হলে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা তুলে নেওয়া হবে। হাজারীবাগে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয় নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানা গেছে।
সরকারের এমন কঠোর অবস্থানের পর ট্যানারি মালিকরা কালক্ষেপণ করতে নানা অজুহাত তৈরি করছেন।
রোববার (০৬ মার্চ) তিনজন মন্ত্রীসহ হাজারীবাগ এলাকা পরিদর্শনে যান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ লেদার ইনস্টিটিউট অডিটরিয়ামে ট্যানারি মালিক, শ্রমিক নেতা ও ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মন্ত্রীরা।
ঢাকার চার নদীসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীর নাব্যতা, নদীর গতি প্রবাহ অব্যাহত রাখতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের সভাপতিত্বে একটি টাক্সফোর্স গঠন করা হয় সরকারের গত মেয়াদে। এই টাস্কফোর্সে ৮ জন মন্ত্রী রয়েছেন সদস্য হিসেবে। তাদেরই একটি প্রতিনিধি দল রোববার ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
ওই মতবিনিময় সভায় তিনজন মন্ত্রীকে এক সঙ্গে পেয়ে ট্যানারি মালিকরা অভিযোগ আর অজুহাতের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। ট্যানারি শিল্প বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন তারা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, আমাদের রাতারাতি সাভারে যেতে চাপ দিলে সেখানে রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনার অশঙ্কা থেকে যাবে। একই সঙ্গে সরকার থেকে আমাদের যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল তা পেয়েছি অত্যন্ত সামান্য। তাই সাভারে যেতে হলে আমাদের সব সুবিধা আগে নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এই শিল্প হুমকির মুখে পড়বে।
তিনি বলেন, আমাদের ট্যানারি মালিকদের ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও, দিয়েছে মাত্র ৫০ কোটি টাকা। তাছাড়া আমাদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিলেও এখনো তার কোনো সুফল পাচ্ছি না। ফলে আমরা আন্তরিক থাকলেও সাভারে যাওয়ার ব্যাপারে সরকার সেভাবে সহযোগিতা করছে না। তবে আমরা আশা করি চলতি বছরেই সবাই সেখানে যেতে পারবো।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, আমরা যেতে চাই, কিন্তু সব সুযোগ-সুবিধা আগে নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্কিন লিমিটেডের মালিক জে এ খোকন ভূইয়া বলেন, কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও আমাদের কিছু লোক চামড়া শিল্প ধ্বংস করে দিচ্ছে। ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। যেমন আমার দু’টি ইউনিট থাকলেও একটি দেখিয়ে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে, যা আমাকে ঠকানো হচ্ছে। এ থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। একই সঙ্গে সরকারের সহযোগিতা চাই।
ট্যানারি ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কালাম আজদ বলেন, এত বড় একটি প্রকল্প হচ্ছে, অথচ শ্রমিকদের জন্য একটুও ভাবা হয়নি। সেখানে এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা কোথায় থাকবে তার ব্যবস্থা না করেই ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের তোরজোর চলছে। এতে এই শিল্পের উন্নয়ন না হয়ে উল্টো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কেননা শ্রমিকদের অনেকেই সেখানে যেতে আগ্রহী না। তাই আগে শ্রমিকদের আবাসন ব্যবস্থা করতে হবে।
তাদের এ ধরনের অভিযোগে বিব্রত তিন মন্ত্রী বলেন, আপনাদের যত অভিযোগ থাকে তা, শিল্প মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। তবে আপনাদের যেতে হবে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজহান খান বলেন, যত কথাই বলুন, নদী বাঁচাতে আপনাদের হাজারীবাগ ছাড়তেই হবে। এইসব অজুহাত দিয়ে পার পাবেন না। সমস্যা থাকলে সরকার সেখানে যাওয়ার পরেও দেখবে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, যা দেখলাম, তাতে মার্চের মধ্যে সভারে ট্যানারি স্থানান্তরে সন্দেহ রয়েছে।
ট্যানারি মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যাই হোক আপনাদের সেখানে যেতে হবে।
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ বলেন, সমস্যা আছে, থাকবে। তারপরেও আপনাদের দ্রুত, অতিদ্রুত যেতে হবে। এরকোন বিকল্প নাই।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মো. হযরত আলী বলেন, ট্যানারি মালিকরা ক্ষতিপূরণ নিয়ে যে অভিযোগ করছেন, তা অমূলক। তারা না জেনেই করছেন। তাদের সাথে আমাদের শর্তই ছিল প্রথম তলার ছাদ ঢালাই হলেই ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ দেওয়া হবে, বাকি টাকা কাজ শেষ হলে। তারা কাজ শেষ করলে আমরা টাকা নিয়ে বসে আছি, দিয়ে দেবো।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা জেলার সভার উপজেলায় কান্দিবৈলারপুর ও চন্দ্রনারায়ণপুর মৌজা এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলার চরনারায়ণপুর মৌজায় ১৯৯ দশমিক ৪০ একর জমির উপর গড়ে তোলা হচ্ছে আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী। যেখানে থাকছে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি)। মোট জমির ১৭ একর ব্যহৃত হয়েছে সিইটিপি নির্মাণে। প্রকল্প এলাকায় ২০৫টি প্লটের মাধ্যমে ১৫৫টি শিল্প ইউনিটকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সিইটিপি চালু হয়েছে ৩০ জানুয়ারি। তবে এখনও সাভারে স্থানান্তরিত হয়নি একটি ট্যানারিও। কিছু ট্যানারি মার্চের শেষ নাগাদ সাভারে নতুন চামড়া শিল্প নগরীতে উৎপাদন শুরু করবে।