বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: আজ থেকে ১৬ মাস আগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির মসনদে আরোহন করেন নরেন্দ্র দামোদর মোদি।
‘আচ্ছা দিন আয়েগা’র এই স্লোগানে অভিভূত কোটি কোটি ভারতবাসীর সামনে মোদি তখন ছিলেন তাদের সব স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি।
কিন্তু ক্ষমতায় বসার সোয়া বছরের মাথাতেই দিল্লির মসনদের বোঝা বহন করতে যেন গলদঘর্ম মোদি।
গুজরাটে মোদির উন্নয়নের তরী তরতর করে এগিয়ে চললেও দিল্লিতে এসে হারিয়েছে দিক।
গত সোয়া বছরের শাসনামলে সরকারের নানা ক্ষেত্রে যে নানা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে পারছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও।
গত বছর লোকসভায় ২৮২টি আসন পাওয়ায় ক্ষমতায় আসার পর বিজেপির মধ্যে এক ধরনের আত্মগরিমা তৈরি হয়েছিলো। দেখা দিয়েছিলো সমালোচকদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা। ফলে দল বা সরকারের মধ্যে আত্মসমালোচনার কোন পরিসর তৈরি হয়নি।
কিন্তু এখন যে প্রশাসনের অবস্থা সুবিধাজনক নয়, তা মোদির কাছে অনেকটাই স্পষ্ট।
মোদি জামানার আগের মনমোহন সরকারের দশ বছরের শাসনামলকে নীতি পঙ্গুত্বের যুগ বলে পরিহাস করেছিলেন অনেকে।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে গত নির্বাচনে মোদিকে ঘিরেই আশার ফানুস উড়িয়েছিলেন তারা। ভারতীয় মিডিয়াও তাতে ঘি ঢেলে সে সময় বাড়তি উচ্ছাস দেখিয়েছিলো মোদিকে ঘিরে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও জন্ম নেয় অতিরিক্ত প্রত্যাশা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সোয়া এক বছর কেটে যাওয়ার পর এই সরকারের থেকে তারা কি পেলেন?
আখেরে তাদের মিলেছে অতিকেন্দ্রীভূত এক শাসন। যার মূলে মূলে রয়েছে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা।
ভারতের মতো বহুত্ববাদী জটিল সমাজব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে সহিষ্ণুতার প্রয়োজন তার ব্যাপক ঘাটতি দৃশ্যমান এই সরকারের মধ্যে।
বিজেপি ক্ষমতায় এসেই বহুল আলোচিত জমি আইন সংশোধনের যে চেষ্টা শুরু করে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিলো আমলাতন্ত্র থেকেই।
ভারতীয় পত্রিকার খবর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও নাকি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলো বিষয়টি নিয়ে একটু কৌশলে এগুতে। তাদের মতে যেহেতু রাজ্যসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তাই শুধু লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এই বিল পাশ করার চেষ্টা না করাই ভাল। বরং ধাপে ধাপে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসভায় সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
কিন্তু ক্ষমতায় এসে বিজেপির শীর্ষ নেতারা তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলেন। ভেবেছিলেন এত বিপুল জনসমর্থন যে সরকারের রয়েছে, তারা তো তুড়ি মেরেই জমি বিল পাশ করানোর ক্ষমতা রাখে।
কিন্তু এখন মোদি সরকার বুঝতে পারছে যে সংসদে যৌথ অধিবেশন ডেকেও বিল পাশ করানো সহজ নয়।
এছাড়া গত সোয়া বছরে দেশের আর্থিক অবস্থারও কোনও নজরকাড়া উন্নতি হয়নি। শেয়ার বাজারের দুর্দশা প্রায় স্থায়ী হতে চলেছে। ইউয়ানের অবমূল্যায়নের কারণে সম্প্রতি চীনের অর্থনীতি ধাক্কা খেলেও তার সুযোগ নিতে পারেনি ভারত।
পাশাপাশি মার্কিন প্রশাসন খুব শিগগিরই তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সুদের হার বাড়াতে চলেছে। এর ফলে তেজি হয়ে পড়বে ডলার। তখন শুধু চীনই নয় সমস্যায় পড়বে ভারতও।
এ অবস্থায় সঙ্কট কাটাতে সুদের হার কমানোর জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন সাফ জানিয়ে দেন এ মুহূর্তে সুদের হার কমানো হবে ভারতের অর্থনীতির জন্য আত্মহত্যার সামিল।
গত সোয়া বছরের মধ্যে একটাও বড় সংস্কারের কর্মসূচি কার্যকর করতে পারেনি মোদির সরকার। সংসদে কোন সংস্কারের প্রস্তাবও পাশ করানো যায়নি। শুধু কিছু সামাজিক প্রকল্পের নাম পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও ০.৫ শতাংশ কমেছে।
অসন্তুষ্ট দেশের বণিক মহলও। তারা মনে করছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার হিসেবে প্রথম বছরে বড় পদক্ষেপ গ্রহণের যে সুযোগ ছিলো তা হাতছাড়া করেছে মোদি সরকার।
এছাড়া আমলাতন্ত্রের মধ্যে অসন্তোষের ছাপ সুস্পষ্ট। ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতের আমলাতন্ত্রের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। আসলে এই আমলাতন্ত্রের জোরেই ভারতের মত এত জটিল বৈচিত্রময় দেশের রাশ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো ব্রিটিশ রাজ। সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন ছিলো স্বাধীনতার পরও। সব সরকারই কমবেশি আমলাতন্ত্রের ওপর অহেতুক ছড়ি না ঘুরিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছেন।
কিন্তু ক্ষমতায় এসেই মোদি যেভাবে দু’জন সিনিয়র স্বরাষ্ট্র সচিব ও একজন পররাষ্ট্র সচিবকে সরিয়ে দিয়েছেন তাতে সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
পাশাপাশি পররাষ্ট্র নীতিতে কিছু ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু অর্জন করতে পারেনি মোদি সরকার। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হলেও এর মূল কৃতিত্ব আসলে আগের মনমোহন সরকার। চুক্তির সব হোমওয়ার্ক ও ফ্রেমওয়ার্ক সম্পন্ন করে গিয়েছিলো আগের ইউপিএ সরকার।
তাছাড়া বেশিরভাগ ভারতীয়র কাছেই মাথাব্যথা পাকিস্তান। অথচ পাকিস্তানের সঙ্গে নীতি কী হিবে তা নিয়ে এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যাচ্ছে মোদি সরকারের মধ্যে।
পাকিস্তানের সঙ্গে কখনও বন্ধুত্ব আবারও কখনও শত্রুতার নীতি গ্রহণের ফলে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে সব মহলে।
এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে দল ও সরকারের মধ্যে।
সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দল ও সরকারের সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের মতো নেতারা।
তার ওপর সুষমা স্বরাজ এবং বসুন্ধরা রাজের সঙ্গে আইপিএল এ দুর্নীতি কাণ্ডের নায়ক ললিত মোদির সঙ্গে মাখামাখির বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে চাউর হয়ে গেলে নতুন করে অস্বস্তিতে পড়ে দল।
এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় বিরোধী দলগুলো।
এছাড়া মাঝেমাঝেই সাম্প্রদায়িকতার জিকির তুলছেন সংঘ পরিবার এমনকি বিজেপিরও কোনো কোনো নেতা। ধমক ধামক দিয়ে তাদের থামিয়ে রাখলেও বিষয়টি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে মোদির জন্য।
এর ওপর আবার সর্বশেষ গুজরাটে ‘প্যাটেল বিদ্রোহ’কে কেন্দ্র করে নিজের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটিতেই অস্বস্তিতে মোদি। প্যাটেল আন্দোলনের নেতা তরুণ হার্দিক প্যাটেল তো জানিয়েই দিয়েছেন, তাদের দাবি মানা না হলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে এবার আর পদ্মফুল নাও ফুটতে পারে।
গত সোয়া বছরে মোদির মুকুটে যোগ হয়নি তেমন কোনো সাফল্যের পালক, তার ওপর এসব অস্বস্তি। সব মিলিয়ে সরকার চালাতে গিয়ে এই মুহূর্তে মোদি যে কিছুটা গলদঘর্ম, তা অনেকটা স্পষ্ট। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম