রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > ‘কাছের মানুষই’ হতে পারে শিশুর সবচেয়ে ভয়ের কারণ

‘কাছের মানুষই’ হতে পারে শিশুর সবচেয়ে ভয়ের কারণ

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন ধারায় এসেছে পরিবর্তন। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় একদিকে যেমন সমাজে উন্নতি ঘটছে, অন্যদিকে বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়ও। কোমলমতি শিশু নিকট আত্মীয় দ্বারা হত্যাসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। পরিবারের নিশ্চুপ ভূমিকা, সময় উপযোগী পদক্ষেপের অভাবে সামাজিক এই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।

সার্বিক দিক থেকে দেখলে বোঝা যাবে কোনো অভিভাবকই তার শিশুর যৌন নির্যাতনের বিষয়ে সচেতন নন। আর এ কারণেই সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধার শিশুরা ভয়ঙ্কর এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হচ্ছে। যা শিশুটিকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাড়া করে ফিরছে। শৈশবের এই ভয়ানক মুহূর্তে অনেকেই আবার বাবা-মায়ের উপযুক্ত সহযোগিতার অভাবে একটি উশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

এভাবে আর বসে না থেকে শিশুর জন্য সুস্থ্য ও সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে এখনই অভিভাবককে এগিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিষেশজ্ঞ ডা. ওয়াসিমা রহমান।

যৌন নিপীড়নে শিশুর ভবিষ্যৎ হয় ভয়াবহ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা শারিরীক এবং মানসিক দুভাবেই নির্যাতনের শিকার হতে পারে। কোনো কারণে বকা-ঝকা করা, মারধর করাটাও শারিরীক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। তবে এসবের মধ্যে শিশুর যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা শিশুকে বেশি পীড়া দেয়। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হলে এই শিশুদের মধ্যে নানা সমস্যা দেখা দেয়। শিশুরা মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্যের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ছোট থেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বড় হতে থাকে। নিজের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং সমাজের চোখে নিজেকে সে ঘৃণীত মনে করে বেড়ে ওঠে। এর বাইরেও বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব শিশুর মধ্যে ব্যক্তিত্ত্ববোধ নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়, কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা কমে যায়। শিশুর মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বিকলতার সৃষ্টি হয়। এতে শিশু তার জীবনের নির্যাতনমূলক অভিজ্ঞতা জেগে থেকে বা ঘুমিয়ে স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেয়ে অস্থিরতায় ভুগতে থাকে। এসব কারণে শিশুর সিজিওফেনিয়া, অপসেশন হতে পারে। এর ফলে শিশুদের আচরণ গম্ভীর হয়ে যায়। তখন তারা অন্যকে সহজে আঘাত করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এমনকি নিজেকে আঘাত করা, আত্মহত্যা করা, সম্পর্ক ধরে রাখার দক্ষতাও হারিয়ে ফেলে। তাই পরিবারের বন্ধনে থাকলেও সে নিজেকে পরিবারের অংশ ভাবতে পারে না।

কীভাবে বুঝবেন?
নির্যাতনের শিকার অধিকাংশ শিশুই তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে না। এজন্য পরিবারকে বিশেষ করে অভিভাবককে শিশুর আচার-আচরণের প্রতি তীক্ষ্ম নজর রাখতে হয়। শিশু যদি সব কাজে বিরক্তিকর আচরণ করে, অস্থিরতা দেখায়, হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে যায়, খেলাধূলা কমিয়ে দেয়, পরিবারের সঙ্গে হাসি-খুশি না থাকে তাহলে শিশুটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে ধরে নিতে হবে।

এছাড়াও নির্যাতনের শিকার শিশুরা অনেক সময় ঘুমের মধ্যে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠবে অথবা সবসময় ভয়ের কথা বলবে। শিশুর চলাফেরায় উগ্রতা প্রকাশ পাবে, ভয়ে কিছু কিছু খেলা থেকে বিরত থাকতে চাইবে অথবা কিছু খেলা নিষেধ করা সত্ত্বেও বারবার খেলতে চাইবে। এছাড়াও শিশুর ব্যবহার আমূলে বদলে যাবে। এমনকি খাওয়া বা পড়ায় তার মন বসবে না।

মনে রাখতে হবে, শিশুর মাঝে যখন পরিবর্তন আসবে তখন সে অবশ্যই আপনাকে তার পরিবর্তিত আচরণের একটি সঙ্কেত দেবে। পরে সেই সঙ্কেত ধরেই আপনাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রতিরোধ করুন নিজের বুদ্ধি ও সাহস দিয়ে
শিশুকে যৌন হয়রানি ও নির্যাতন থেকে দূরে রাখতে পরিবারকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে যিনি শিশুর দিকে সবসময় খেয়াল রাখছেন তাকে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শিশু কী নিয়ে খেলছে, কার সঙ্গে মিশছে, যাদের সঙ্গে মিশছে তারা কেমন, সেসব দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শিশু যাদের সঙ্গে মিশছে তাদের মেলামেশার মধ্যে অসংলগ্ন কিছু চোখে পড়লে সেই সঙ্গ থেকে তাকে আলাদা করতে হবে।

পরিবার ছাড়াও স্কুলগামী শিশুদের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে পরিবার এবং অভিভাবকের পক্ষ থেকে। সে ক্ষেত্রে স্কুলের স্টাফ বা শিক্ষকদের মানসিকতা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে হবে, স্টাফদের আচরণ অস্বাভাবিক হলে নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে স্কুলে সপ্তাহে বা মাসে অভিভাবক সভা করতে হবে। বাচ্চাদের কাছে স্কুলের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে হবে। বাবা-মাকে শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

যৌন কার্যকলাপে উদ্দীপ্ত করতে পারে এমন খেলা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে। সামাজিকভাবে কোনো কিছু দমন করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিশুকে শেখাতে হবে। গৃহকর্মীদের বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ছেলে শিশুরা ছেলেদের থেকে মেয়ে শিশুরা মেয়েদের দ্বারাও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারে।

শিশুর বয়স ৩/৪বছর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে আলাদা ঘরে ঘুমোতে দেয়া ভালো। উন্নত দেশে জন্মের পর থেকেই শিশুকে একই রুমের আলাদা কটেজে রাখা হয়।

প্রতিটি শিশুর ১১ বছর বয়স থেকেই হরমোনাল পরিবর্তন শুরু হয়। হরমোনের কারণে শিশুর শারিরীক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এ বয়সের সম্মুখীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে বাব-মায়ের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সঙ্গ দিতে হবে। তবে এরপরেও কিছু ঘটে গেলে শিশুটি পরবর্তীতে যেন ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

আমাদের দেশে আইন আছে অনেক, কিন্তু প্রয়োগ নেই। তাই শুধু আইনের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। শিশুকে নিয়মিত কাউন্সেলিং দিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে গড়ে তুলতে হবে।

যাদের দ্বারা শিশু নিপীড়নের শিকার হতে পারে
শিশুদের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক ভালো বা শিশুরা যাদের সঙ্গে বেশি মিশছে বা যারা শিশুর কাছের মানুষ তাদের দ্বারাই শিশুর নিপীড়নের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে বাসার পরিচারিকা, স্কুল-বাসার শিক্ষক, কর্মচারী, দারোয়ান, ড্রাইভার, প্রতিবেশি, নিকটাত্মীয় এবং ভাই-বোনদের নিজেদের মধ্যেও এমন হতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে সমাজের কথা চিন্তা করে পরিবারকে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। বরং পরিবারের উচিৎ হবে ঠাণ্ডা মাথায় শিশুদের কাছ থেকে বিষয়টি শোনার। পরে সেই অনুযায়ী শিশুকে সতর্ক করে দেয়া ও তাদের প্রতি বেশি বেশি খেয়াল রাখা। প্রয়োজনে বাসায় এমন আত্মীয়কে রাখা যাবে না যারা শিশুদের সঙ্গে শিশুসুলভ আচরণ করতে পারে না।

যারা এসব অন্যায় করছে তারা কারা?
শিশুদের সঙ্গে যারা এই অনৈতিক কাজটি করছেন তাদের অধিকাংশ মানসিক রোগগ্রস্ত। আর বাকিরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেয়ে এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছেন। শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে এমন অনেকেই বড় হয়ে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। এমন হতে পারে যে, শৈশবের ভয় তার মাঝে আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়েছে।

অনেক সময় বড়দের মধ্যে মানসিক রোগের কারণে যৌন কার্যক্রমের পরিধি বেড়ে যায়। তখন তারা শিশু বা বৃদ্ধ ভেবেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

এদের মধ্যে আরো কিছু গুরুতর মানসিক রোগী রয়েছে যারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। অ্যান্টিসোশ্যাল মানসিকতা থাকায় যেকোন কাজই তাদের দ্বারা সম্ভব হয়ে থাকে।

সে ক্ষেত্রে এই ধরনের লোকদের সমাজ থেকে না তাড়িয়ে সমাজের মাঝেই তার সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে দিতে হবে। তাকে অভিজ্ঞ মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং করাতে হবে। তবে ব্যক্তিত্বজনিত মানসিক সমস্যা হলে দীর্ঘমেয়াদি সাইকলোজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দিয়ে তার মধ্যে থাকা ভবিষ্যত অপরাধ প্রবণতাকে প্রশমিত করতে হবে। বাংলামেইল২৪ডটকম