বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে ছিটমহল ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘদিনের জটিলতার আনুষ্ঠানিক অবসান হয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়ার পর এ সমস্যা নিরসনে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী একটি চুক্তিও করেছিলেন। তবে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওই চুক্তি কার্যকরের সব প্রক্রিয়া সেরে উঠতে পারেনি ভারত; নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসে যা একবছরের মাথায় করেছেন। মোদির ঢাকা সফরে এ চুক্তি অনুসমর্থনের দলিল হস্তান্তর হয় দুদেশের মধ্যে। এরপর জানানো হয় আগামী ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে শুরু হবে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময়।
আর এর ফলে আরেক দফা বাড়ছে বাংলাদেশের আয়তন; পরিবর্তন আসবে দেশের মানচিত্রেও। তবে নিখুঁত সীমানারেখা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরো বেশ কয়েক মাস। এই বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি লাভবান না হলেও দীর্ঘদিনের মানবিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে।
বাংলাদেশ ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুল জলিল বাংলামেইল২৪ডটকমকে বলেন, ‘দুদেশের মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি বিনিময়ের ফলে কোথাও ভারতের সীমানারেখা বাংলাদেশের বর্তমান সীমানার ভেতর ঢুকে যাবে। আবার ঠিক উল্টো ঘটনাও ঘটবে। এই পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আয়তন কত হচ্ছে তা এই মুহুর্তে বলা সম্ভব না। কেননা অধিদপ্তর এখনো দলিল হাতে পায়নি। দলিল পাওয়ার পর সীমানা পিলার স্থাপনের পরই নিখুঁতভাবে আয়তন জানানো যাবে।’
এর আগে সমুদ্রসীমা মামলায় নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পায় বাংলাদেশ। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত। গত বছর ৭ জুলাই ওই রায় পাওয়া যায়। তারও আগে মিয়ানমারের সঙ্গে রায়ে বাংলাদেশ পায় ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এ সবই যোগ হবে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশের সঙ্গে।
সমুদ্রসীমা রায়ের ফলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের সীমা, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের মানচিত্রে যোগ হচ্ছে আরো নীট ১০ হাজার ৫০ একর জমি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হবে তা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে জানান, ‘এর ফলে সবচেয়ে বড় লাভ হলো ছিটমহলবাসীর মানবিক সমস্যার সমাধান হবে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চুক্তিটি মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চার রাজ্য- আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানারেখায় পরিবর্তন আসবে। একই সঙ্গে ছিটমহল সমস্যা, অপদখলীয় ভূমি ও অচিহ্নিত সীমানা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক পুস্তিকার মুহুরী নদী (বিলোনিয়া) সেক্টর শিরোনামে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সীমানা পিলার (২১৫৯/৪৮-এস) থেকে সীমানারেখা আরো পশ্চিম দিকে টেনে ১৯৭৭-৭৮ সালের যৌথ সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি মুহুরী নদী এলাকার নকশায় প্রদর্শিত বার্নিংঘাটের দক্ষিণ সীমায় গিয়ে মিলবে। এরপর তা উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে বার্নিংঘাটের বাইরের সীমা বরাবর গিয়ে বর্তমান মুহুরী নদীর কেন্দ্রে মিশবে। এটি আবার বিদ্যমান মুহুরী নদীর মধ্যস্রোত বরাবর গিয়ে ২১৫৯/৩-এস সীমান্ত পিলার পর্যন্ত যাবে। এটি হবে স্থায়ী সীমানা। তৃতীয় অংশে ‘লাঠিটিলা ও ডুমাবাড়ি’ শিরোনামে রেডক্লিফের আঁকা সীমানারেখা ১৩৯৭ নম্বর পিলার থেকে সোজা দক্ষিণে ডুমাবাড়ি, লাঠিটিলা ও বড় পুটনিগাঁও মৌজার লোহার ব্রিজ পর্যন্ত এবং এরপর তা দক্ষিণ দিকে পুটনিছড়া বরাবর সিলেট-ত্রিপুরা সীমান্ত পর্যন্ত (পিলার নম্বর ১৮০০) টানার কথা বলা হয়েছে।
চতুর্থ অংশে দইখাতা ৫৬ (পশ্চিমবঙ্গ-জলপাইগুড়ি)/পঞ্চগড় শিরোনামে বলা হয়েছে, এই অংশের স্থায়ী সীমান্তরেখা ১৯৯৭-৯৮ সালের জরিপ অনুযায়ী দইখাতা-৫৬-এর সীমানা বরাবর ৪৪৪/৬ নম্বর সীমান্ত নকশায় (স্ট্রিপ শিট) বিদ্যমান ৭৭৪/৩২-এস সীমান্ত পিলার থেকে শুরু হবে। এরপর তা দইখাতা-৫৬-এর (পূর্ব থেকে পশ্চিম) দক্ষিণ সীমানা অনুসরণ করে ১৮ নম্বর পয়েন্ট পর্যন্ত যাবে।
প্রটোকলের তৃতীয় অনুচ্ছেদে পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও আসাম সেক্টরে অপদখলীয় ভূমির সীমানা প্রসঙ্গে বলা হয়, ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত উভয় দেশের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের যৌথ উদ্যোগে চূড়ান্ত করা অপদখলীয় ভূমির নকশা অনুযায়ী অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের মাধ্যমে স্থায়ী সীমান্ত নির্ধারিত হবে।
বোসমারী-মাধুগারি (কুষ্টিয়া-নদীয়া) এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যৌথ জরিপ ও ২০১১ সালের জুন মাসে দুই দেশের সম্মতি অনুযায়ী, এ সীমান্ত ১৯৬২ সালের মানচিত্র অনুসারে ১৫৪/৫-এস সীমানা পিলার থেকে শুরু করে মাথাভাঙ্গা নদীর পুরনো ধারা অনুসরণ করে ১৫১/১-এস নম্বর সীমান্ত পিলারে গিয়ে মিশবে।
চর মহিষকুণ্ডি (কুষ্টিয়া-নদীয়া) এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যৌথ জরিপ ও ২০১১ সালের জুনে উভয় দেশের সম্মতির ভিত্তিতে এ এলাকার সীমানারেখা বিদ্যমান সীমান্ত পিলার ১৫৩/১-এস থেকে টেনে মাথাভাঙ্গা নদীর তীর বরাবর ১৫৩/৯-এস নম্বর সীমান্ত পিলার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।
বেরুবাড়ী (পঞ্চগড়-জলপাইগুড়ি) এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ১৯৯৬-১৯৯৮ সালে যৌথভাবে চিহ্নিত সীমান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের অপদখলে থাকা বেরুবাড়ী (পঞ্চগড়-জলপাইগুড়ি) এবং ভারতের অপদখলে থাকা বেরুবাড়ী ও সিংঘাপাড়া-খুদিপাড়ার (পঞ্চগড়-জলপাইগুড়ি) সীমানারেখা আঁকা হবে। প্রটোকলের অপদখলীয় ভূমি অংশে মেঘালয় সেক্টরের ছয়টি এলাকার উল্লেখ রয়েছে।
ডাউকি/তামাবিল এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ১২৭৫/১-এস নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে ১২৭৫/৭-এস নম্বর সীমান্ত পর্যন্ত সীমান্তরেখা আঁকা হবে। উভয় পক্ষ এ সীমান্তের শূন্যরেখায় বেড়া দেয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছে। মুক্তাপুর-ডিবির হাওর এলাকা প্রসঙ্গে প্রটোকলে বলা হয়েছে, ভারতীয় নাগরিকরা এ এলাকার কালীমন্দির পরিদর্শন করতে পারবেন। এছাড়া মুক্তাপুর এলাকার পাড় থেকে মুক্তাপুর/ডিবির হাওর এলাকার জলসীমানা থেকে ভারতীয় নাগরিকরা পানি উত্তোলন ও মাছ ধরতে পারবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান সীমান্ত তৈরি হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাবসানের ফলে। বর্তমান বাংলাদেশের অঞ্চল তখন পূর্ব বাংলা নামে পরিচিত ছিল, যেটি নবগঠিত দেশ পাকিস্তানের পূর্ব অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পাকিস্তান অধিরাজ্যে থাকারকালে পূর্ব বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তান -এ নামটি পরিবর্তন করা হয়েছিল। পাকিস্তানী শাসনের অবসান হলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রথম মুখোমুখি হয় সীমানা চিহ্নিতকরণ সমস্যার। তিনদিকে ভারতের সীমান্ত থাকায় ১৯৭৪ সালে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলামেইল২৪ডটকম