বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা : আজ ২৪ এপ্রিল। সাভারের রানা প্লাজা ধসের সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হল। দিনটির ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্ব
ওই ভবন ধ্বসের ঘটনায় ভবন থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানা শ্রমিকসহ এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক-কর্মচারী নিহত হন। ঘটনায় আহত হন আরও কয়েক হাজার। এদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। পরিচয়-সঙ্কটের কারণে ক্ষতিপূরণের অর্থ পৌঁছায়নি দেড় শতাধিকের বেশি নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে। ক্ষতিপূরণের আশায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন অনেক স্বজনহারা পরিবারগুলো। এখনো ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে অনেককে।
কি ঘটেছিল সেদিন?
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টায়। সাভারের নয় তলা ভবন রানা প্লাজার পাঁচটি কারখানার শ্রমিকরা যে যার মতো করে কাজে যোগ দিচ্ছেন। তখনও তারা জানতেন না কী ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। সকাল সাড়ে ৮টায় একযোগে চালু করা হয় ডজন খানেক জেনারেটর। কেঁপে ওঠে নয় তলা ভবনটি। এর কিছুক্ষণের মধ্যে বিশাল এ ভবনটি ধসে পড়ে। সাথে সাথে ঝড়ে যায় হাজার শ্রমিকের প্রাণ। ভবনে আটকে পড়া ও হাসপাতালে মারা যাওয়াসহ সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৭৫ জনে। ঘটনায় আহত হন আরও কয়েক হাজার। দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এত শ্রমিক মারা যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
শ্রমিকদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, আগে থেকেই ফাটল ধরেছিল ওই ভবনে। হরতাল থাকায় কাজে আনা হয়েছিল শ্রমিকদের। ঝুঁকিপূর্ণ ওই ভবনে ছিল বিশাল আকৃতির জেনোরেটর। আর এক সঙ্গে কাজ করতো সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক। ভূগর্ভস্থ তলায় ছিলো গাড়ি রাখার জায়গা। দ্বিতীয় তলার বিপণিকেন্দ্রে বহু দোকান ছিল। তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত পোশাক কারখানা। এর ওপরের দুটি তলা খালি ছিল। ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল প্রথম তলায়। ২৩ এপ্রিল ২০১৩ তারিখে ফাটল নিশ্চিত হওয়ার পর ভবন ছেড়ে চলে যেতে বলা সত্ত্বেও, অনেক গার্মেন্টস শ্রমিকদের পরের দিন কাজে ফিরতে বলা হয়, তাদের সুপারভাইজার ভবনটিকে নিরাপদ ঘোষণা করে। ২৪ তারিখ ৯তলা ভবনটি সকাল ৯টার দিকে প্রথম তলা বাদে বাকি সবগুলো তলা ধসে পড়ে। ধসে পড়ার সময় ভবনটিকে প্রায় ৩ হাজার কর্মী ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল নয়টার দিকে হঠাৎ করে বিকট শব্দ এবং কাঁপনে তারা ভূমিকম্পের আশঙ্কা করেন। পরে বেরিয়ে দেখেন বিরাট এলাকা ধুলা বলিতে ধোঁয়াটে হয়ে পড়েছে। ভবনের নিচে চাপা পড়ে কর্মস্থলে হাজারের বেশি শ্রমিক মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। ওই ঘটনা এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত হয়।
এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি অনেকেই
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, রানা প্লাজা ট্রাজেডির দুই বছর পার হলেও এখনো ১৫৯ জন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। ফলে সব ধরনের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শ্রমিকের পরিবার।
সিপিডির তথ্য অনুযায়ী, তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর উদ্যোগে বিভিন্ন সংস্থা থেকে রানা প্লাজায় নিহত শ্রমিকদের ৫১৩ শিশুকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আর বিলস থেকে ২৫ জন এতিম শিশুকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর বাইরে তেমন কোনো সুবিধা পায়নি অন্য শিশুরা।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রানা প্লাজার ঘটনায় নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ৩৬৫ নিখোঁজ শ্রমিকের মধ্যে ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ২০৬ জনের পরিচয় সনাক্ত হয়েছে। তারা কিছু সহায়তা পেলেও বাকি ১৫৯ শ্রমিকের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে সব ধরনের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব শ্রমিকের পরিবার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঘটনায় নিহত শ্রমিকরা প্রতিশ্রুতির ক্ষতিপূরণের ৭০ শতাংশ পেলেও আহত,পঙ্গু ও চাকরি হারানো শ্রমিকরা রয়েছেন কষ্টকর জীবনে। ওই সময়ের অধিকাংশ শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান নিম্নমানের হয়েছে। অনেকে এখনো কাজ করার অনুপযোগী। সেই সময়ে আহত শ্রমিকরা তাৎক্ষণিক বিভিন্ন সংগঠনের সহায়তায় চিকিৎসা পেয়েছে। পরবর্তীতে ঢাকা ও সাভারের আশপাশের শ্রমিকরা কিছু সহায়তা পেলেও বাইরের জেলাগুলোর শ্রমিকরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এখনো ভয় তাড়া করে বেড়ায় জেসমিনকে
বড় বিল্ডিং দেখলে জোরে শব্দ শুণলে এখনো ভয় পাই। রানা প্লাাজা দুর্ঘটনার দুই বছর পরও ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে রানা প্লাাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক জেসমিনকে। দুর্ঘটনায় জেসমিনের মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যায়। এখলো অসুস্থ তিনি। গত দুই বছরে তেমন কোনো সাহায্যও পায়নি জেসমিন।
দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জেসমিন বলেন, ২০১০ সালে স্বামী মারা যাওয়ার পর রানা প্লাজায় চাকরি নেই। ঘটনার দিন সকালে বাচ্চাকে রেখে অফিসে যাই। যাওয়ার পরই দুর্ঘটনা ঘটলে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যায়। আমি দুই দিন বিডিংয়ের নিচে চাপা পরে ছিলাম। দুই দিন পর বিল্ডিং থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। ৬ দিন পর সিএইচএমে নেওয়ার পর নিজেকে অনুভব করি। ৬ মাসের চিকিৎসার পরও পুরোপুরি সুস্থ না হতেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে দেয়। কোনো কাজ করতে পারছি না। এখনো প্রতিমাসে চার থেকে পাচঁ হাজার টাকার ঔষধ প্রয়োজন। টাকার অভাবে তা কিনতে পারে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার আক্ষেপ করে জেসমিন বলেন, লোকের মুখে শুনি আহতদের জন্য অনেক সাহায্য দেওয়া হচ্ছে। তবে যোগাযোগ করে দেখি সবার পাওয়ার খাতা খালি। আমাকে হাসপাতালে চলাকালিন বিলস থেকে বিকাশের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। পরে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আরও ১০ হাজার টাকা পেয়েছি।
সেই দিনের ঘটনায় পঙ্গু হওয়া আরেক শ্রমিক বরিশালের মরিয়ম। মরিয়ম জানান, রানা প্লাজার ৫ম তলায় কাজ করতাম। বিল্ডিং ভেঙ্গে গেলে পঙ্গ হয়ে যাই। ৪ মাস চিকিৎসার পর বাড়ি চলে যাই। ক্ষতিপূরণের জন্য বিলস থেকে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছি। ব্র্যাক থেকে কিছু সাহায্য নিয়ে ছোট্ট একটা দোকান দিয়েছে।
রানা প্লাজায় স্বামী হারানো মনোয়ারা বেগম জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর লাশ দাফনের জন্য ২০ হাজার পেয়েছি। এর পর নানা জায়গায় ঘুরে আজও কোনো টাকা পাইনি। দুই তিন বার ব্যাংকে একাউন্ট করেছি। একাউন্ট করতে খরচ হয়েছে। খুব কষ্টে জীবন কাটছে। জানি না সামনে কি অপেক্ষা করছে।