স্টাফ রিপোর্টার ॥ আগামীতে সরকার পরিবর্তন হলেও নিজেদের মুনাফা যেন অব্যাহত থাকে, সে ল্েয এখন থেকেই তৎপর হয়ে উঠেছে কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে সরকার। তারা গণহারে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
দেশের স্বার্থে নয়, মূলত এ সিন্ডিকেটের চাপের কারণেই কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে মেয়াদ শেষের আগেই। বিদ্যুৎ খাতে ভয়াবহ বিপর্যয নেমে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর কুইক রেন্টাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ শেষ না হতেই ১৫ বছর মেয়াদী আইপিপিতে (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) রূপান্তরের দেন-দরবার চালিয়ে আসছেন। যাতে সরকার পরিবর্তন হলেও তাদের টিকিটি ধরতে না পারে।
সরকারও নিজেকে সঁপে দিয়ে তাদের ইচ্ছা পূরণ করতে উদ্যোগী হয়েছে। সবাইকে আইপিপিতে রূপান্তরের আবেদন দিতে বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জল হোসেনকে প্রধান করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে বিষয়টিতে মতামত দেওয়ার জন্যও বলা হয়েছে।
কমিটির একাধিক সদস্য সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিদ্যমান আইনে আইপিপিতে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে সরকার চাইলে বিশেষ আইনে আইপিপি করতে পারে। কমিটি মনে করে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। যেহেতু বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে তেমন অগ্রগতি নেই।
কমিটির সদস্যরা আরও জানিয়েছেন, রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো খরচ ভাড়া হিসেবে পেয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। তাই এখন এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আর ভাড়ার বিষয়টি থাকবে না।
তবে সূত্র জানায়, ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ (বিদ্যুৎ নেই, বিল নেই) বিষয়ে মতামত দিতে চেয়েছিল এ কমিটি । এমন রিপোর্ট দেওয়ার খবর জানাজানি হলে কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তাদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে কমিটি। ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট’ শর্ত পরে তুলে ফেলা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। তা না হলে এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ জানান, এভাবে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ নেই। সরকার বেআইনি কাজ করছে। সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতকে ধ্বংস করে আর কতো কুইক রেন্টাল সিন্ডিকেটের স্বার্থ দেখবে!
তিনি দাবি করেন, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে যে সময়ের জন্য চুক্তি করা হয়, সে সময়ের পুরো খরচ ভাড়া হিসেবে পেয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। মেয়াদান্তে সরকারকে একটি টোকেন মানির বিনিময়ে মালিকানা হস্তান্তর করার কথা। এখন এগুলো সরকারের সম্পদ হয়ে যাওয়ার কথা। আইপিপির েেত্র তো তাই হয়।
কুইক রেন্টালের েেত্র যেহেতু আলাদা কোনো আইন নেই, এেেত্রও আইপিপির মতো হওয়ার কথা বলেও দাবি করেন বিডি রহমতউল্লাহ।
এদিকে কমিটি নয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এগুলো হচ্ছে— সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ১০৫ মেগাওয়াট ও মদনগঞ্জ সামিট পাওয়ার লিমিটেডের ১০০ মেগাওয়াট, পাওয়ারপ্যাক মতিয়ারার কেরানীগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, সিনহা পাওয়ারের আমনুরা ৫০ মেগাওয়াট, নর্থ পাওয়ার সলুশন লিমিটেডের (এনপিএসএল) কাটাখালী ৫০ মেগাওয়াট, খান জাহান আলী পাওয়ার কোম্পানির নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট, এ্যাকর্ন ইনফ্রাকচার লিমিটেডের জুলদা ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ্-বাংলা পাওয়ারের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট ও ওরিয়নের মেঘনাঘাট আইইএল কনসোটিয়াম অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটের মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হচ্ছে, নয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নতুন মেশিনে তৈরি। যদিও আইনগতভাবে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে আইপিপিতে রূপান্তরের কোনো সুযোগ নেই। তবে সরকার চাইলে বিশেষ আইনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে আইপিপি করতে পারে। ২০২০ সাল পর্যন্ত সার্বণিক বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে না আসা পর্যন্ত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিকল্প নেই।
বর্তমান সরকার মতায় এসে তিনটি রেন্টাল (তিন বছর মেয়াদী) ও ১৭টি কুইক রেন্টাল (পাঁচ বছর মেয়াদী) বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। যার মোট উৎপাদন মতা রয়েছে এক হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উৎপাদনে আসে আরও পাঁচটি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে চলতি বছর শিকলবাহা, ঠাকুরগাঁও, পাগলা ও খুলনার ৪টি কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হবে যাবে। আগামী বছর শেষ হবে ভেড়ামারা ও সিদ্ধিরগঞ্জের দু’টি কেন্দ্রের। ঘোড়াশালের দু’টি কেন্দ্রের মেয়াদ আছে ২০১৫ সাল পর্যন্ত। ২০১৬ সালে মেয়াদ শেষ হবে নোয়াপাড়ার দু’টি এবং মেঘনাঘাট, খুলনা, মদনগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে একটি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও কুইক রেন্টাল নিয়ে গঠিত বিশেষ কমিটির প্রধান মোফাজ্জেল হোসেন জানান, শুধুমাত্র বিদেশি কোম্পানি এগ্রিকো ছাড়া আর কোনোটাই রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়। সবগুলোই আইপিপির আদলে গড়া। রেন্টালের একটি বিশেষণ থাকে তা হচ্ছে, এগুলো রেডিমেট ছোট ছোট জেনারেটরের হয়। কোনো স্থাপনা থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে যারা কুইক রেন্টাল বসিয়েছেন, তারা আইপিপির মতো বিশাল স্থাপনা করেছেন।
আর যেহেতু এগুলোর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। তাই মেয়াদ বৃদ্ধির পে কমিটি বলেও জানান মোফাজ্জেল হোসেন।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক জানিয়েছেন, সমালোচনা অনেক করা যায়। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দেশের স্বার্থেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কুইক রেন্টাল দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখেছে।