বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
ঢাকা : আজ ১০ মহররম মুসলিম জাহানের সবচেয়ে মর্মান্তিক বেদনাদায়ক দিন। হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র, নবী নন্দিনী মা ফাতেমার আদরের দুলাল হজরত ইমাম হোসাইন ফোরাতের তীরে কারবালায় এজিদের নির্দেশে সীমারের হাতে নিহত হন। সে এক নির্মম হৃদয়বিদারক ঘটনা। ইমাম হোসাইনের ছিন্ন মস্তক বর্শার ফলায় গেঁথে দুরাচারী সীমার দামেস্কে নিয়ে যায় এজিদের দরবারে। সেখানে সে এজিদের কাছে পুরস্কারও পায়। ইমাম বংশের একমাত্র শিশু জয়নাল আবেদীন ছাড়া আর কেউ বেঁচে ছিলেন না। ইমাম পরিবারকে দামেস্কে বন্দী করা হয়েছিল। যদিও একপর্যায়ে ইমাম মোহাম্মদ আবু হানিফা মুসলিম জাহানের অন্য শাসক ও বীরদের নিয়ে এজিদের শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন। সে অনেক কথা, অনেক ইতিহাস। মুসলমান মাত্রই এদিনে থাকে ভারাক্রান্ত। তাই দিনটি এলেই আমরা নানাভাবে কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার তর্পণ করি। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে প্রার্থনা করি, মুসলিম জাহানের সংহতি, সম্প্রীতি, ইমান দিন, হেদায়েত করুন। পুরো সপ্তাহটাই কেমন যেন ঝঞ্ঝা-বিক্ষোভে ভরা ছিল। আবার হরতালের হাতছানি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কয়েকজনের ফাঁসি। এক সময় এ দেশের আপামর মানুষ মনে-প্রাণে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চেয়েছে। এখনো বহু মানুষ বিচার চায়। কিন্তু তারপরও কেন যেন বিচার প্রক্রিয়ার নানা অসঙ্গতির কারণে আগের সেই উৎসাহ নেই। সেই স্বতঃস্ফূর্ততা কিছুটা হলেও কমেছে। অন্যদিকে জনাব গোলাম আযমের জানাজায় লাখো জনতা, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাটোরের জনসভায় বিপুল জনসমাগম, ইতিহাসের চরম ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিভ্রাট- কেন যেন নানাজন নানা প্রশ্ন তুলছেন। আবুধাবি থেকে ফিরে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সফর খুবই সফল হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে, কানাকড়িও অর্জন হয়নি। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, সরকার ইচ্ছা করলে যখন খুশি নির্বাচন দিতে পারে। তার এ মন্তব্যে বিরোধী দল তাদের দাবি মেনে নিয়ে সরকারের নির্বাচনে আসার শুভ ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন। হতেও পারে, বিরোধী দলের আশাবাদই সত্য। আবার এও তো হতে পারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে বলেছেন, সরকার যখন খুশি তখন নির্বাচন দিতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাও অসত্য নয়। সরকার চাইলে সত্যি যখন খুশি তখন নির্বাচন দিতে পারে। এতে কারও দাবি মানা, না মানা বুঝায় না।
সেদিন সারা দেশে এক মহা বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে গেছে। সেও আবার পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর গ্রিড থেকে ভেড়ামারা গ্রিডে বিদ্যুৎ না আসা বিভ্রাটের কারণ। এখন পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাদের বিদ্যুৎ আসে ৪-৫শ মেগাওয়াট। আমাদের প্রয়োজন ৭-৮ হাজার মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে উৎপাদন ৬ হাজার মেগাওয়াটের উপরে। ৫০০ মেগাওয়াট না আসায় আমাদের বাদবাকি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হবে কেন? ভারত থেকে বিদ্যুৎ না এলে আমাদের কেন্দ্রগুলোর কী আসে যায়? বাঙ্গালকে হাইকোর্ট বহু দেখানো হয়েছে। এখনো এই আধুনিক জামানায় সেই দু-একশ বছর আগের মতো ভীতু বাঙালি, খাটো বাঙালি বলে হাইকোর্ট দেখাতে গেলে চলবে কেন? এখন ইন্টারনেটের জামানা। একটু বুঝেশুনে মাজায় একটা কিছু শক্ত করে বেঁধে হাইকোর্ট দেখানোর চেষ্টা করতে হবে। কেউ যদি কাঁচা ভাবে অমন কিছু দেখাতে চায় তাহলে বুমেরাং হবে। সত্যিই যদি আপনাআপনি বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে থাকে তাহলে এত লোকজনের কী দরকার? আর তা যদি না হয় তাহলে এটা কি দেশকে বিপদে ফেলার, সরকারকে বিব্রত করার কোনো কৌশল? সেটাও তো খুঁজে দেখা দরকার।
সাধারণ মানুষ অত কিছু বোঝে না। তারা তাদের সাধারণ বুদ্ধিতে যা দেখে এবং বুঝে তাই তারা বিচার করে। যদি মেইন লাইনে বিদ্যুৎ থাকে একটা বাড়ির কোনো ঘরের বিদ্যুৎ চলে গেলেও সারা বাড়ি অন্ধকার হয় না। যে ঘরের ফিউজ বা সার্কিট ব্রেকার যায় সেই ঘর অন্ধকার হয়। আবার ঠিকঠাক করে দিলে সব ঘরে আলো জ্বলে। এটা যদি একটা সাধারণ বাড়িতে বিদ্যুৎ প্রবাহের সিস্টেম হয় তাহলে বহরমপুর থেকে ভেড়ামারা বিদ্যুৎ লাইন অচল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশ কেন অন্ধকার হবে? হাসপাতালে রোগী কেন কষ্ট পাবে? শহরবাসীর বাড়িতে পানি ওঠা কেন বন্ধ হবে? শীত আসছে আসছে করছে তাই রক্ষা। কিন্তু তবুও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া। হরতালের কারণে পরীক্ষা না হয় পিছিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের লেখাপড়া তো করতে হবে। জানি না এত বড় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের রহস্য দেশবাসী কোনোদিন জানতে পারবে কিনা। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের দিন বিকালে আমার দেশ পত্রিকা অফিসে গিয়েছিলাম। পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে বিএসইসি ভবনের ১১ তলা। এর আগেও ভবনটিতে বেশ ক’বার আগুন লেগেছে। কারণ অনুসন্ধানের তদন্ত রিপোর্ট জনসম্মুখে আসেনি। এবারও আসবে তেমন আলামত দেখা যাচ্ছে না। আগুন লাগার ২০ ঘণ্টা পর গিয়েও নিচে সিঁড়িতে দম বন্ধ করা ধোঁয়ার গন্ধ পেয়েছি। লিফট ছাড়া এ বয়সে ১১ তলায় উঠেছিলাম। পুরো ফ্লোর পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। আল্লাহকে শুকরিয়া জানাতে হয় আর কোনো ফ্লোরে আগুন যায়নি, কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। সারাদিন নানা কথা শুনছিলাম। কেউ কেউ বলছিল পত্রিকার লোকজনই আগুন দিয়েছে। দিতেও পারে। আগুন দিয়ে যার লাভ সেই তো দেবে, আগুন দিয়ে যার লাভ হবে না সে দেবে কেন? ওখানে গিয়ে নানাজনের কথাবার্তা শুনে যা মনে হলো, পত্রিকা কর্তৃপক্ষের আগুন দিয়ে তেমন লাভ নেই। কারণ তাদের কোনো ইন্স্যুরেন্স নেই। তারা তাদের অফিস সরানোর জন্য জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল। এয়ারকন্ডিশন, যন্ত্রপাতি খুলছিল, কিন্তু কোনো কিছুই বের করেনি। কম্পিউটার, সার্ভার, দলিল-দস্তাবেজ সব ছিল। বিএসইসির সঙ্গে বকেয়া ভাড়া নিয়ে দেন-দরবার চলছিল। তারা নাকি চুক্তিমতো বিএসইসির পাওনা পরিশোধ করে দিয়েছেন। তারপর তাদের আগুন দেওয়ার উদ্দেশ্য কী? লাভ কী? এক-দেড় বছর সাংবাদিক-কর্মচারীরা বেতন পান না। এ আগুনে কি তাদের বেতনের ফয়সালা হবে? কোনো কিছুই যদি না হয় তাহলে তারা আগুন দেবে কেন? নাকি এটা কোনো দুর্ঘটনা। বিদ্যুৎ থেকে আগুনের সূত্রপাত তাই-বা কী করে বলা যায়। যেদিন বা যে সময় আগুন লেগেছে সেদিন বিদ্যুৎ লাইনে কোনো নাড়াচাড়া হয়নি। মনে হয় কেউ কোনো সুইচও দিতে যায়নি। শুক্রবার অফিসে লোকজন ছিল একেবারেই কম, না থাকার মতো। তাহলে এমন ঘটনা ঘটল কেন? কীভাবে ঘটল? আমাকেও কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছে। মনে হাজারও প্রশ্ন জেগেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো জবাব খুঁজে পাইনি। ফেরার পথে আরটিভি, এনটিভির ফ্লোরে গিয়েছিলাম। তাদের দেখতে গিয়েছি বলে তারা ভীষণ খুশি। তাদের কী সহানুভূতি জানাব, আমরা যাওয়ায় তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শেষ ছিল না। শুক্রবার আগুনের সময় ক্যামেরায় উদ্বিগ্ন মোসাদ্দেক আলী ফালুকে দেখেছিলাম। তাই তাকে খুঁজেছিলাম। সেও খুবই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চা-পান করাতে না পেরে দুঃখ করে সবাইকে খেজুর খাইয়েছে। জানি না, কেন বিএসইসি ভবনে বার বার আগুন লাগে। এটা কি নির্মাণের ত্রুটি, না অন্যকিছু। ২০০৭ সালে আগুন লাগার পর উত্তরদিকে যে আগলা সিঁড়ি বানানো হয়েছে, ওটা না থাকলে আমার মনে হয় এবার আগুনে উপরতলা ভেঙে পড়ত। কারণ একটা পত্রিকা অফিসে যে পরিমাণ কাগজপত্র থাকে আর কাগজে আগুন লাগলে তা পেট্রলের চেয়েও বেশি জ্বলে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর থেকে আপদ-বিপদ, বালা-মসিবত মনে হয় কোনোদিনই দূর হবে না। এতদিন ছিলাম আসল-নকল-ভুয়ার জ্বালায়, এখন আবার নতুন উপসর্গ শুরু হয়েছে। ১৫ বছরের কম-বেশি এতকাল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা হলো না। আর কোনোদিন হওয়া সম্ভবও না। ইদানীং শুনছি, রাজাকার-আলবদরের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। রাজাকার আলবদরের নতুন তালিকা করতে হবে কেন? এটা সত্য, মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোনো তালিকা ছিল না, কিন্তু রাজাকার-আলবদর-আলশামস, শান্তি কমিটির সবার তালিকা আছে- খুঁজলেই পাওয়া যেত, এখনো পাওয়া যাবে। ছোট ছোট বাচ্চা অফিসার দিয়ে এখন রাজাকার-আলবদর-দালালদের তালিকা করতে গেলে সেটা আরেক জগাখিচুড়ি হবে। নীতিবান মানুষ তো এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। প্রায় সবাই তো দলকানা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দলে দলে বিভক্ত, এমনকি মসজিদ-মন্দিরেও বিভাজন। ন্যায়-সত্য-আদর্শ কোণঠাসা। মাজা সোজা করে মানবতা দাঁড়াতেই পারছে না। শক্তির বাড়াবাড়ি এত বেশি, কারও শক্তি যে চিরস্থায়ী নয়, এটা কেউ মানতেই চায় না।
এতকাল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় চালানো হয়েছে আধা-মন্ত্রী দিয়ে। এবার একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিককে পুরো মন্ত্রী করা হয়েছে। ভেবেছিলাম কিছু উন্নতি হবে। আর বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া মেডেল থেকে সোনা চুরি হবে না, মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা স্বস্তি পাবে। কিন্তু এ যে দেখছি আগের হাল যেদিক দিয়ে যায় পিছের হালও সেদিক দিয়েই যায়। ক’দিন আলোচনা হচ্ছে, ১৫ বছরের কম বয়সের কেউ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকতে পারবে না। ১৫ বছরের কম বয়স সত্যিই নাজুক বয়স। কিন্তু তারচেয়েও কম বয়সে দু-চারজন যে মুক্তিযোদ্ধা ছিল না তা তো নয়। ব্যতিক্রম তো সব ক্ষেত্রেই ছিল তা প্রমাণ করতে কোনো এক নামিদামি পত্রিকা লিখেছে- ‘টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী মাঠে কাদেরিয়া বাহিনী যে অস্ত্র দিয়েছে সেখানে অস্ত্র পরিদর্শনের সময় বঙ্গবন্ধুর কোলে কাদেরিয়া বাহিনীর ১১-১২ বছরের সদস্য শহিদুল ইসলাম লালুকে দেখা গেছে। কাদের সিদ্দিকীর দেহরক্ষী বাহিনীর বজলুর বয়স ছিল ১৫ বছরের কম।’ আগেরটা সত্য হলেও পরেরটা সত্য নয়। বজলু এখনো বেঁচে আছে। দুর্র্ধষ যোদ্ধা। তার বয়স ছিল ২০-এর কাছাকাছি। কাদের সিদ্দিকীর দলকে তখন যুদ্ধ করতে হতো। দিনে রাতে ৩০-৪০ মাইল হাঁটতে হতো। শক্ত সবল লোকের দরকার ছিল। হ্যাঁ, আমার দলেও অনেক ১৫ বছরের নিচে মুক্তিযোদ্ধা ছিল। লালুর সঙ্গে ভুলুও ছিল। লালু চায়ের দোকানের বয় সেজে হানাদার শিবিরে বোমা ফাটিয়ে কয়েকজনকে নিহত-আহত করায় বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিল। দুর্ভাগ্য এই এত বছর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোমন্দের ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারলাম না। অনেক প্রকৃত যোদ্ধা সরকারি তালিকাভুক্ত হলো না। শুনে অবাক হই, বাটাজোরের মহু সরদার, চর পাকুল্যার শামসু, ভূয়াপুরের ভরত, গাইবান্ধার হালিম সরদার, মিরপুরের আনিছুর রহমান এখনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়নি। তাদের কাছে আমার ওই সময়ের স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট আছে, জেনারেল এমএজি ওসমানীর সার্টিফিকেট আছে, তবু তারা মুক্তিযোদ্ধা না। অনলাইনে তালিকাভুক্ত হওয়ার ফরম ছাড়া হয়েছে। সেখানে দেখলাম অস্ত্র কোথায় জমা দিয়েছেন তার রশিদ দরকার। মুক্তিযোদ্ধারা কার কাছে অস্ত্র জমা দেবে, কে জমা নেবে? আমরা কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র বঙ্গবন্ধুর পদতলে বিছিয়ে দিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু তো কোনো রশিদ দেননি, আমরাও সাহস করে চাইনি। কবে এসব অসঙ্গতি দূর হবে? আদৌ হবে কিনা জানি না। অনেকের যেমন ছেলেমেয়ের বিয়ে দেখতে, নাতি-পুতি দেখতে ইচ্ছা জাগে, আমারও তেমনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এসব অসঙ্গতি আদৌ দূর হবে কিনা দেখতে বড় সাধ জাগে।
লেখক : রাজনীতিক
বিডি-প্রতিদিন