শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > বিমাসুবিধাসহ ৬০% পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ

বিমাসুবিধাসহ ৬০% পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের বিমাসুবিধার আওতায় আনার সুপারিশ করছে জাতীয় চাকরি ও বেতন কমিশন। সরকার এ সুপারিশ গ্রহণ করলে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হবে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য এবং জীবনবিমা ও দুর্ঘটনাজনিত অক্ষমতা বিমা। এর মাধ্যমে ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ৫০ লাখের বেশি মানুষ বিমাসুবিধা পাবে।

কমিশনের আরেকটি নতুন সুপারিশ হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বা স্বাস্থ্য ভাতা থেকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কেটে রেখে বিনিময়ে তাঁদের পরিবারের সব সদস্যকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যয়ের সুবিধা দেওয়া। কেউ মারা গেলে অথবা দুর্ঘটনার কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়লেও দেওয়া হবে আলাদা পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা। তবে সুবিধার পরিমাণ নির্ভর করবে প্রিমিয়ামের পরিমাণের ওপর। বিমার প্রিমিয়াম কে দেবে, তা নিয়ে একাধিক বিকল্প ভাবছে কমিশন।
জাতীয় চাকরি ও বেতন কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন এ কমিশন বর্তমানে সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে। ১৭ সদস্যের এ কমিশন গঠিত হয় গত বছরের ২৪ নভেম্বর, যার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ ডিসেম্বর। মেয়াদ শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই সুপারিশসংবলিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দেবেন কমিশন চেয়ারম্যান।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নতুন কাঠামোতে বেতন সর্বোচ্চ ৭০ হাজার ও সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকার কাছাকাছি সুপারিশ করা হবে। বর্তমান কাঠামোতে বেতন সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ও সর্বনিম্ন চার হাজার ১০০ টাকা। সুপারিশ তৈরির ক্ষেত্রে বাবা-মাসহ ছয়জনের একটি পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় এবং দুই সন্তানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বিবেচনায় রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এতে বেতন বাড়ানোর সুপারিশ থাকছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত।
বিদ্যমান কাঠামোতে ২০টি ধাপ (গ্রেড) রয়েছে। নতুন কাঠামোতে ধাপ কমার কথা বলা থাকছে। বিদ্যমান কাঠামোর ১২ হাজার টাকার অষ্টম ও ১১ হাজার টাকার নবম ধাপ একীভূত করে একটি এবং ছয় হাজার ৪০০ টাকার একাদশ ও পাঁচ হাজার ৯০০ টাকার দ্বাদশ ধাপকে একীভূত করে আরেকটি ধাপ করার সুপারিশ থাকবে।
অবশ্য কমিশনের সব সুপারিশ সরকার গ্রহণ করে না। আবার এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে, তা-ও কমিশন চূড়ান্ত করেনি।
বিমার আওতায় সবাই: কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন গতকাল সোমবার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংবিধানে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার অধিকার এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা—এ দুই বিষয়কে মাথায় রেখে আমরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিমা পলিসির আওতায় আনার সুপারিশ করব।’
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিমাসুবিধার জন্য প্রিমিয়াম বাবদ অর্থ ব্যয় করতে হবে। অর্থসংস্থানের উৎস নিয়ে কয়েকটি বিকল্প চিন্তাও চলছে। এগুলো হচ্ছে সম্পূর্ণ অঙ্ক সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া, বেতন থেকে কেটে রাখা, চিকিৎসা ভাতা বাড়িয়ে সেখান থেকে কেটে রাখা এবং কিছু অংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বাকি অংশ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া ইত্যাদি।
এ ছাড়া সবার নামে পাঁচ বছরের জন্য একটি করে স্বাস্থ্য কার্ড দেওয়ার সুপারিশ করছে কমিশন। এ কার্ড দেখিয়ে সরকারি এবং মাঝারি মানের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়া যাবে। এক পরিবারের একাধিক সদস্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হলে প্রিমিয়াম জমা হবে শুধু কনিষ্ঠজনের কাছ থেকে।
প্রসঙ্গত, এ ধরনের স্বাস্থ্যবিমা পদ্ধতি সারা দেশের জন্য চালুর এক পরিকল্পনা এর আগে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এ ব্যাপারে কিছু সুপারিশ করেছে বলে জানান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। এতে ১০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত প্রিমিয়ামের কথা বলা হয়। ১০০ টাকা প্রিমিয়ামে দুই লাখ, ২০০ টাকায় চার লাখ, ৩০০ টাকায় ছয় লাখ, ৪০০ টাকায় আট লাখ এবং ৫০০ টাকায় ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যয়ের সুযোগ রাখা যেতে পারে বলে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট বেতন কমিশনকে জানায়।
স্বাস্থ্যবিমার পাশাপাশি জীবনবিমা ও দুর্ঘটনাজনিত অক্ষমতা বিমারও সুপারিশ করেছে ইনস্টিটিউট। সুপারিশে বলা হয়েছে, জীবনবিমা পলিসির আওতায় ১০০ টাকা মাসিক প্রিমিয়াম দিয়ে হঠাৎ কেউ মারা গেলে এককালীন পাঁচ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। ২০০ টাকা প্রিমিয়ামে পাওয়া যাবে ১০ লাখ টাকা। এই প্রিমিয়াম দিয়ে দুর্ঘটনা বিমার ক্ষেত্রেও একই রকম সুবিধা পাওয়া যাবে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্যোগটি বাস্তবায়িত করা গেলে সরকারি চাকরিজীবীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি লাভবান হবে দেশের বিমা খাত।’ তবে তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি নতুন উপায় বের করার পরামর্শ দেন তিনি।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের আওতায় গ্রুপ বিমার আওতায় রয়েছেন। এ জন্য সবার কাছ থেকে মাসে ৪০ টাকা করে কেটে নেওয়া হয়। যার বিনিময়ে মৃত চাকরিজীবীর উত্তরাধিকারকে এককালীন এক লাখ টাকা দেওয়া হয়।
সরকারি চাকরিজীবীদের বিমা পলিসির আওতায় আনার ব্যাপারে সুপারিশ তৈরিতে ভারতের তামিলনাড়ু সরকারের মডেল অনুসরণ করা হয়েছে বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি জানান, মাসে ৫০০ টাকা হিসাবে ১২ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর কাছ থেকে বছরে ৭২০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম সংগৃহীত হবে। ১৫ শতাংশ হিসাবে এতে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাবদ সরকার পাবে ১০০ কোটির বেশি টাকা। হামিদ বলেন, বিমা পলিসি বিষয়ে করা এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সহজ হবে, সরকার যদি মূসকের সমান টাকা অনুদান দেয়।
২০ জনের এক প্লট ও ব্যাংকঋণ: সরকারি চাকরিজীবীদের ২০ জনের একটি দলকে পাঁচ কাঠার মতো একটি করে প্লট দেওয়ার সুপারিশ থাকতে পারে বেতন কমিশনের প্রতিবেদনে। প্লটটি হতে পারে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে। তবে অবশ্যই তা হবে সাশ্রয়ীমূল্যে, যাতে ২০ জন চাকরিজীবী মিলে একই প্লটে বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করতে পারেন।
বর্তমানে বাড়ি করার জন্য এক লাখ ২০ হাজার টাকা সুদমুক্ত ঋণ পান সরকারি চাকরিজীবীরা। মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘পরিমাণটি হাস্যকর।’ ব্যাংকাররা ৫ শতাংশ সুদে মোটা অঙ্কের টাকা ঋণ পান, সচিবালয় বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা তাহলে দোষ হয়ে গেল—উল্টো প্রশ্ন রাখেন তিনি। বাড়ি করা বা কেনার ঋণ তাই ৪০ মাসের মূল বেতনের সমান করা হতে পারে বলে জানান ফরাসউদ্দিন।
কমিশন চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ হবে সুদযুক্ত, কোনোভাবেই সুদমুক্ত নয়। সুদের হার হতে পারে ৫ শতাংশ।’ এ ধারণা কার্যকর করা গেলে ঢাকার ওপর চাপ কমবে বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন।
ভাতা যৌক্তিকীকরণ: কমিশনের সুপারিশে কোনো ভাতাই বাতিল করা হচ্ছে না বরং যৌক্তিকীকরণ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর পরিমাণের মিল নেই বলে কমিশন সূত্র জানায়। এগুলোর মধ্যে অবসর সুবিধা, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা, যাতায়াত, আপ্যায়ন, প্রেষণ, মহার্ঘ, উৎসব ও শ্রান্তি বিনোদন, ধোলাই ভাতা, টেলিফোন, গাড়ি ও মুঠোফোনবিষয়ক আর্থিক সুবিধা এবং রেশনসুবিধা।
টাইমস্কেল, সিলেকশন গ্রেড এবং ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে বর্তমানে অসংগতি রয়েছে। কমিশন তা-ও দূর করার সুপারিশ করবে বলে জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর জন্য আলাদা বেতনকাঠামো করার কথা বলা হয়েছিল, তা বেতন ও চাকরি কমিশনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কর্মপরিধির মধ্যে তো রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকও রয়েছে।’
গত ঈদুল আজহার আগে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শুরু অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১ জুলাইয়ের আগে নতুন বেতনকাঠামো কার্যকর করার সম্ভাবনা কম। তবে সরকারি চাকরিজীবীরা ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা পাচ্ছেন। প্রথম আলো