শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > ৮৩ শতাংশ পলিসিই তামাদি ॥ মাঝ পথে জীবন হারাচ্ছে বিমা!

৮৩ শতাংশ পলিসিই তামাদি ॥ মাঝ পথে জীবন হারাচ্ছে বিমা!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: দেশে প্রতি বছর ৮৩.৩ শতাংশ বিমা পলিসি তামাদি হচ্ছে। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে গ্রাহকের অবহেলা, অজ্ঞতা ও অসচেতনতা আর কোম্পানিগুলোর মুনাফা লোভী আচরণেই এই ভয়াবহ চিত্র। সিংহভাগ বিমাই মাঝপথে গতি হারাচ্ছে। আইনের ফোঁকর গলে পকেট ভারি করে নিচ্ছে বিমা কোম্পানিগুলো।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিমা কোম্পানিগুলো বছরে যে পরিমাণ নতুন পলিসি বিক্রি করছে, তামাদি হয়ে যাচ্ছে প্রায় তার সমপরিমাণ কিংবা বেশি।

সূত্র নিশ্চিত করেছে, কিছু কিছু কোম্পানির ক্ষেত্রে তামাদি হওয়া পলিসির সংখ্যা নতুন বিক্রি করা পলিসির সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোনওটি রয়েছে যার বছরে নতুন পলিসির চেয়ে তামাদি পলিসির সংখ্যা তিন থেকে চারগুন বেশি।

১৫টি কোম্পানির পরিসংখ্যান বাংলানিউজের হাতে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে কোম্পানিগুলো মোট ১৪ লাখ সাত হাজার ৯৭৪টি নতুন পলিসি বিক্রি করেছে। আর এ বছরে তাদের তামাদি ঘোষিত পলিসির সংখ্যা ১১ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৩টি। যা নতুন পলিসির ৮৩ শতাংশ।

নথিপত্র বলছে, ১৫টি কোম্পানির মধ্যে ৫টি কোম্পানির তামাদি পলিসির সংখ্যা ওই বছর নতুন বিক্রি করা পলিসির সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। প্রগতি লাইফ, সানলাইফ, সন্ধানী লাইফ, পপুলার লাইফ ও প্রগ্রেসিভ লাইফ এই পাঁচ কোম্পানির নাম।

প্রগতি ইন্সুরেন্স এই দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে। প্রতিষ্ঠানটির বছরে নতুন পলিসি যা হচ্ছে তার চেয়ে তামাদি হচ্ছে পায় চার গুন বেশি। ২০১৩ সালে নতুন ৩০ হাজার ৩৭০টি পলিসি বিক্রি করে প্রগতি। আর এ বছর তাদের তামাদি হয় এক লাখ ১৪ হাজার ৫৩০টি পলিসি।

পপুলার লাইফ একই বছরে বিক্রি করেছে দুই লাখ সাত হাজার ৮৮০টি পলিসি। এই কোম্পানির বছরে তামাদি হয়েছে দুই লাখ ৩৫ হাজার ১৭৮টি পলিসি। প্রগ্রেসিভ লাইফ বিক্রি করেছে ২৩ হাজার ৬২টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ৩৯ হাজার ৪৫৭টি। সন্ধানী লাইফ বিক্রি করেছে ৬৮ হাজার ৬১৫টি পলিসি, তামাদি হয়েছে এক লাখ সাত হাজার ৭৬৯টি। আর সানলাইফ বিক্রি করেছে ৪১ হাজার ৫৬টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ৫৬ হাজার ৬৩১টি পলিসি।

এ বিষয়টি ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি- আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদের নজরে আনা হলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কোম্পানিগুলোতে পলিসির মেয়াদ পুর্ণ করতে না পারা গ্রাহকের এই সংখ্যা আশঙ্কাজনক।

বিমার প্রতি গ্রাহকদের অসচেতনাকে দুষলেও এক্ষেত্রে বিমা কোম্পানিগুলোর দায় রয়েছে বলে মনে করেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, একটু পুরোনো পলিসিগুলোর ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম আদায়ে এজেন্টদের অনাগ্রহও পলিসি তামাদি হওয়ার বড় কারণ।

শেফাক আহমেদ বলেন, পলিসি তামাদির হার যাতে কমে আসে সে জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে এজেন্টদের কমিশন হারে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে পলিসি তামাদি হওয়ার হার কমবে।

এদিকে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, পলিসি তামাদি হওয়ার কারণে বছরে প্রতিটি কোম্পানির কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে তামাদি হওয়া পলিসিই হয়ে উঠেছে মুনাফার প্রধান উৎস।

তামাদি থেকে বছরে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা লাভ করছে এমন কোম্পানিও রয়েছে বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। আর এক্ষেত্রে তাদের বড় সহায়ক হচ্ছে বিমা আইন।

নাম প্রকাশ না করে একাধিক কোম্পানির কর্মকর্তা বাংলানিউজের কাছে কোম্পানিগুলোর মুনাফালোভী এই মনোভাবের দিকটি ব্যাখ্যা করেছেন।

গ্রাহক মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারলে বা পলিসি পূর্ণতা (প্রতিটি পলিসি পূর্ণতা পেতে গ্রাহককে ২ বছর কিস্তি দিতে হয়) পাওয়ার আগেই গ্রাহক প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ করলে কোম্পানিগুলোই লাভবান হয়। এক্ষেত্রে আইন অনুসারে গ্রাহক কোনো টাকা দাবি করতে পারেন না। ফলে নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ে কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম থাকে। যাতে বছরে বছরে তাদের ঘরে আসে কোটি কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জীবন বিমা কোম্পানিগুলো একক বিমা ও ক্ষুদ্র বিমার আওতায় নানা ধরণের পলিসিপত্র বিক্রি করছে। এসব পলিসির মেয়াদ ৩ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত। তবে বেশিরভাগ গ্রাহকেরই আগ্রহ ১০ থেকে ১২ বছর মেয়াদি পলিসির প্রতি। এর মধ্যে একক বিমার বিভিন্ন পলিসিতে প্রিমিয়াম নেওয়া হচ্ছে মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক ও বার্ষিক ভিত্তিতে।

অন্যদিকে ক্ষুদ্র বিমার বিভিন্ন পলিসির প্রিমিয়ামের কিস্তি নেওয়া হচ্ছে সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে। গ্রাম ও শহরের নিম্নবিত্ত মানুষকে টার্গেট করেই কোম্পানিগুলো ক্ষুদ্রবিমার পলিসি বিক্রি করছে।

আইন অনুযায়ী, প্রথম বছরে প্রিমিয়াম আয়ের ৯০ শতাংশই কোম্পানি খরচ করতে পারে। অর্থাৎ প্রথম বছরে পলিসি তামাদি হলে কোম্পানির লাভ হয় (কোম্পানির কাছে থেকে যায়) আদায় করা প্রিমিয়ামের ১০ শতাংশ। আর নবায়নের ক্ষেত্রে পলিসি তামাদি হলে কোম্পানির লাভ হয় ৮৫ শতাংশ। কারণ নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১৫ শতাংশের বেশি কোম্পানি খরচ করতে পারে না।

পলিসি তামাদি হওয়ার ফলে এমন লাভের সম্ভবনা থাকায় কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের (এজেন্ট) উপর নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ে তেমন চাপ দেয় না, এ কথা বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করেছেন অনেক নামি দামি কোম্পানির কর্মকর্তারাই।

অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী, বিমা পলিসি বিক্রি ও প্রিমিয়ামের অর্থ আদায়ের দায়িত্বে থাকা এজেন্টরা প্রথম বছরে আদায় করা প্রিমিয়ামের উপর ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পান। আর নবায়ন প্রিমিয়ামের ক্ষেত্রে এজেন্টরা দুই বছর কমিশন পান। এর মধ্যে নবায়নের প্রথম বছরে (পলিসির দ্বিতীয় বছর) সর্বোচ্চ কমিশন প্রিমিয়াম আয়ের উপর ১০ শতাংশ এবং পরের বছরে ৫ শতাংশ। তবে এর পরের বছরগুলো অর্থাৎ তিন বছরের পরে এজেন্ট কোনো কমিশন পান না। ফলে নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ে এজেন্টের কোনো আগ্রহ থাকে না।

এতেই মাঝপথে বিমা থেকে হারিয়ে যান গ্রাহকরা।

গ্রাহকরা এখনো বিমার ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেনি, সে কথা স্বীকার করে নিয়ে এই কর্মকর্তারা বলেন, এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো।

সূত্র জানায়, পলিসি তামাদি হওয়ার পর গ্রাহকের ৫ বছর পর্যন্ত পলিসিটি সচল করার সুযোগ থাকে। এক্ষেত্রে গ্রহককে বকেয়া প্রিমিয়ামের অর্থসহ একটি নির্দিষ্ট হারে জরিমাণা দিতে হয়। সাধারণত এ জরিমাণার হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে থাকে। তবে পলিসি তামাদি হওয়ার পর জরিমানা দিয়ে সচল করার হার খুবই সীমিত। আর সেটারও কারণ গ্রাহকদের অসচেতনা ও অজ্ঞতা।

ডেল্টা লাইফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) উত্তম কুমার সাধু বাংলানিউজকে বলেন, ওভার সেল, গ্রাহককে সঠিক তথ্য না দেওয়া, যোগাযোগের সমস্যা ও গ্রাম পর্যায়ের ক্ষুদ্র পলিসি গ্রাহকদের আর্থিক ভারসাম্য না থাকার কারণে বিমা পলিসি তামাদি হয়ে যায়।

তিনি বলেন, পলিসি তামাদি হলেও গ্রাহক কিছু জরিমাণা দিয়ে ৫ বছরের মধ্যে আবার পলিসি সচল করতে পারেন। তবে অসেচতনতার কারণে তামাদি পলিসি গ্রাহকরা তেমন একটা সচল করেন না।

অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, ২০১৩ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফ বিক্রি করেছে ৪১ হাজার ৩৪৯টি পলিসি, এর বিপরীতে তামাদি হয়েছে ৪০ হাজার ৭৬টি। ন্যাশনাল লাইফ বিক্রি করেছে দুই লাখ ২২ হাজার ৯৩৭টি, তামাদি হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৮৪৯টি।

প্রাইম ইসলামী লাইফ বিক্রি করেছে ৫৫ হাজার ৬৮টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ৩৮ হাজার ৩৫৯টি। মেঘনা লাইফ বিক্রি করেছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৮২টি পলিসি, তামাদি হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ১৭৭টি।

হোমল্যান্ড লাইফ বিক্রি করেছে ২৪ হাজার ৩৯৮টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ১৭ হাজার ৩৪টি। রূপালী লাইফ বিক্রি করেছে ৪৪ হাজার ৫৪৫টি, তামাদি হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৭০টি।

ডেল্টা লাইফ বিক্রি করেছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৪২৬টি পলিসি, তামাদি হয়েছে এক লাখ সাত হাজার ১৬৮টি। ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ বিক্রি করেছে এক লাখ ২৬ হাজার ৪৯৫টি পলিসি, তামাদি হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৭৪টি। সানফ্লাওয়ার লাইফ বিক্রি করেছে ৩৩ হাজার ৬৫৫টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ২০ হাজার ২৩৮টি।

মেটলাইফ আলিকো বিক্রি করেছে এক লাখ ৫৭ হাজার ৪৩৬টি পলিসি, তামাদি হয়েছে ৩২ হাজার ১২৩টি।

আইডিআরএ’র সদস্য সুলতান উল আবেদীন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, পলিসির মেয়াদ পূর্ণতার জন্য গ্রাহকের আর্থিক স্বচ্ছলতা বড় বিষয়। কিন্তু এজেন্টদের পিড়াপিড়ি আর বড় বড় স্বপ্ন দেখানোর কারণে আর্থিক স্বচ্ছলতার বিষয়টি বিবেচনা না করেই গ্রাহকরা বিমার পলিসি কেনেন। পরে একবার পলিসি হয়ে গেলে কয়েকটি কিস্তি নেওয়ার পর এজেন্ট আর খোঁজ নেন না। এতে ঝরে পড়েন গ্রাহক। আর এটিই পলিসি তামাদি হওয়ার পিছনে একটি বড় কারণ। তাছাড়া নবায়ন হওয়া প্রিমিয়ামের উপর এজেন্টরা তেমন একটা কমিশন পাননা। ফলে এ বিষয়ে তাদের আগ্রহ কম থাকে। যা পলিসি তামাদি হওয়ার একটি কারণ।

সুলতান উল আবেদীন বলেন, জীবন বিমার পলিসির তামাদির হার যাতে কমে আসে সে জন্য আমরা নিয়মিত আলোচনা করছি। তামাদি পলিসির হার কমিয়ে আনতে শিগগিরই সম্ভাব্য সব ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হবে।

ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামাল এম এ নাসের পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলোর বড় বড় টার্গেটকে দুষেছেন।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে জীবন বিমা কোম্পানিগুলো নতুন ব্যবসা শুরু করে বড় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এতে এজেন্টরা বার বার গ্রাহকের কাছে ধরনা দিয়ে পলিসি বিক্রি করে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের কতটুকু সামর্থ আছে তা বিবেচনা করা হয় না। যেমন পাঁচ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিতে পারবেন এমন গ্রহকের কাছে বিক্রি করা হয় ২০ হাজার টাকা প্রিমিয়ামের পলিসি। ফলে এক পর্যায়ে গ্রাহক প্রিমিয়ামের টাকা দিতে পারে না। ফলে পলিসি তামাদি হয়ে যায়। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম