শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > “আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী বখাটেরা যেন কোনোভাবেই মাফ না পায়”

“আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী বখাটেরা যেন কোনোভাবেই মাফ না পায়”

শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিল ঋতু। ক্লাসে তার রোল নম্বর ছিল ৩। বড় হয়ে শিক্ষক হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু কিশোরী মেয়েটির সব স্বপ্ন-সম্ভাবনা শেষ করে দিল পাড়ার বখাটেরা।
দিনের পর দিন বখাটেদের অত্যাচার-অপমান সয়ে এসেছে মেয়েটি। শেষমেশ শ্লীলতাহানিচেষ্টার অপমান আর সইতে পারল না সে; লজ্জা, ঘৃণা আর অপমানে দিশাহারা মেয়েটি বিষপান করে চিরবিদায় নিল দুঃসহ জগৎ থেকে। মারা যাওয়ার আগে মেয়েটির শেষ আর্তি ছিল, ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী বখাটেরা যেন কোনোভাবেই মাফ না পায়।’
ঢাকার খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া ইস্ট পয়েন্ট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী উম্মে কুলসুম ঋতুর (১৫) আত্মহত্যার জন্য পরিবার ও এলাকাবাসী দায়ী করছে পাড়ার বখাটে শিমুল চন্দ্র, তার সহযোগী রফিকসহ আরো কয়েকজনকে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই ঋতু গত শনিবার রাতে নিজের ঘরে বিষ পান করে আত্মহত্যা করে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী খিলগাঁও থানার এসআই শাহজাহান রবিবার বলেন, স্কুলছাত্রী ঋতুর মৃত্যুর ঘটনায় বখাটে শিমুল চন্দ্র ও তার সহযোগী রফিকসহ আরো কয়েকজনকে আসামি করে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা প্ররোচনা মামলা হয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনেও ঘটনার সত্যতা মিলেছে। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকেলে ঋতুর লাশ খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়ায় নেওয়া হয়।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ঋতুর মৃত্যুর ঘটনায় এলাকায় শোক আর ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। সকাল থেকেই এলাকায় বিক্ষোভ করেছে ঋতুর স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী ও এলাকাবাসী। তারা কেউই ফুটফুটে মেয়েটির অকালমৃত্যুর ঘটনা মেনে নিতে পারছে না। তারা ঘটনায় জড়িত বখাটেদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।
ঋতুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বলেন, “রাতে বিষপান করার কথা শোনার পরপরই তিনি ও অন্য শিক্ষকরা ঋতুর বাসায় যান। এ সময় ঋতুর অবস্থা খারাপ ছিল। হাসপাতালে আনার সময় সে কিছু কথা বলতে পেরেছিল। এ সময় ঋতু আমাকে বলেছিল, ‘স্যার, আমি তো মারা যাব; ওই বখাটেরা যেন মাফ না পায়।”
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহজাহান বলেন, বখাটে শিমুল চন্দ্র ও তার সহযোগী রফিকসহ আরো কয়েক সহযোগী মেয়েটির মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে শিমুল, রফিকসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঘটনার পর রাতেই অভিযান চালানো হলেও এজাহারভুক্ত আসামিরা পলাতাক থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি।
যেভাবে ঘটনা : পারিবারিক সূত্র জানায়, ঋতু গত শনিবার বিকেলে কোচিং শেষে পূর্ব নন্দীপাড়ার ছোট বটতলার ১ নম্বর স্কুল রোডে তাদের ‘বরিশাল হাউজ’ নামের বাসায় ফেরে। এ সময় স্থানীয় বখাটে শিমুল চন্দ্র ও তার সহযোগী রফিকসহ আরো কয়েকজন তার পিছু নেয়। বখাটে শিমুল তার সহযোগীদের নিয়ে বাসার সামনে এসে ঋতুকে উত্ত্যক্ত করার পাশাপাশি গালাগাল করতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের বাজে কথা বলে তাকে অপমান করে। এরপর সন্ধ্যায় শিমুল আবার ঋতুর বাসার সামনে আসে। এ সময় বাসায় ঋতু ছাড়া আর কেউ ছিল না। এই ফাঁকে বখাটে শিমুল বাসায় ঢুকে দরজা খোলা পেয়ে ঋতুর শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায়।
ঋতু বাধা দিলে তার চুল ধরে মারধর করে। একপর্যায়ে শিমুল চলে গেলে ঋতু ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাসায় থাকা ‘তেলাপোকা মারা ওষুধ’ খায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ঋতুর নানি ফাতেমা ও ছোট বোন মিতু বাসায় এসে দরজা বন্ধ দেখে ধাক্কাতে থাকে। অনেকক্ষণ পর ঋতু দরজা খুলে দেয়। নানি ও ছোট বোন ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় ঋতু কিছুটা অস্বাভাবিক। পরে তার বিষপানের কথা জানতে পেরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে রাত ১১টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক ঋতুকে মৃত ঘোষণা করেন।
বৃদ্ধ ফাতেমা বলেন, ‘বিকেলে বখাটে শিমুল চন্দ্র বাসার সামনে এসে গালাগাল করে। তখন আমি শিমুলকে তাড়িয়ে দিই। এরপর ঋতুকে বাসায় রেখে পাশের বাসায় যাই কিছুক্ষণের জন্য। ফিরে এসে দেখতে পাই বাসার দরজা বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পর দরজা খুলে দেয় ঋতু। ঘরে ঢুকেই দেখতে পাই রিতুর নাখ-মুখে ফেনা। এর পরই কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে যায় সে।’
বখাটে শিমুলের বাবাও হত্যা মামলার আসামি : শিমুল চন্দ্রের বাবার নাম রঞ্জন মণ্ডল। তিনি একটি হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি। শিমুল লেখাপড়া জানে না। এলাকায় বখাটে হিসেবেই তার পরিচিতি। স্থানীয় রফিকসহ আরো কয়েকজন যুবকের সঙ্গে সে এলাকায় মাদক ব্যবসায়ও জড়িত। তার বিরুদ্ধে এলাকায় স্কুল-কলেজের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে এলাকাবাসীর কাছ থেকে।
ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বখাটে শিমুলের বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ। ঋতু মারা যাওয়ার পর ওই রাতেই এলাকার লোকজন শিমুলের বাড়িতে হামলা চালায়। এর আগেই শিমুল ও তার মা-বাবা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় বলে স্থানীয় লোকজন জানায়।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, রাতে পুলিশ শিমুলকে না আটকাতে পারলেও তার বাবা রঞ্জনকে আটক করে ছেড়ে দেয়। এরপর সকালে বাবা-ছেলেসহ পরিবারের সবাই এলাকা থেকে লাপাত্তা হয়।
দুপুর ১২টায় টিনশেড আধাপাকা বাড়িটির কাছাকাছি যেতেই কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। ভেতরে গিয়ে দেখা যায় স্বজন আর প্রতিবেশীদের ভিড়। এই বাসাতেই গত শনিবার রাতে স্কুলছাত্রী উম্মে কুলসুম ঋতু বিষপান করে। বৃদ্ধা ফাতেমা নাতির শোকে আহাজারি করছেন- ‘আমাগো একি সর্বনাশ হইল গো! আমার চান্দের মতো নাতিডারে ওরা বাঁচতে দিল না। ওগো শাস্তি হইব। ওগো কড়া শাস্তি চাই।’
নানির পাশে বসে ঋতুর ছোট বোন মিতুও আহাজারি করছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিতু বলে, ‘ওই বখাটের জন্য আমার আপু স্কুলে যেতে পারত না। ওরা আমার আপুকে মাইরা ফালাইছে। ওগো বিচার চাই।’
এর আগে ঋতুর মৃত্যু নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলে। এলাকাবাসী ও ইস্ট পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষার্থীরা ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে ঋতুর হত্যাকারী শিমুল ও রফিকের বিচার দাবি করে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
ঋতুর সহপাঠী রোখসানা আক্তার বলে, ‘ঋতু খুব ভালো মেয়ে ছিল। আমরা এক সঙ্গেই ছোটবেলা থেকে এই স্কুলে লেখাপড়া করি। বখাটেরা ওকে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে সব সময় উত্ত্যক্ত করত।’
ঋতুর সহপাঠী ফারহানা, রেহানা, মারুফাসহ আরো কয়েকজন জানায়, বখাটে শিমুলের কারণে গত বৃহস্পতিবার ঋতু স্কুলে আসেনি। ওরা রাস্তায় ঋতুকে সব সময় উত্ত্যক্ত করত। এ নিয়ে ওর মন খারাপ থাকত।
স্কুলের সামনে ঋতুর শিক্ষক হোসেন শরিফ বলেন, ঋতু লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। নবম শ্রেণিতে ওর রোল ছিল ৩। স্থানীয় বখাটে শিমুল, রফিকসহ তাদের সহযোগীরা ঋতুকে বিভিন্ন সময় উত্ত্যক্ত করত বলে অভিযোগ পেয়েছিলেন তাঁরা। শনিবার স্কুলের প্রধান শিক্ষক জহিরুল ইসলাম শিক্ষকদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে বখাটেদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু রাতেই ঋতু মারা যায়।
তিন ভাইবোনের মধ্যে ঋতু ছিল বড়। তার বাবা আশিক হোসেন ও মা আয়েশা আক্তার সাথী ডেমরার একটি গার্মেন্টে চাকরি করেন। ঋতুর নানি ফাতেমা বেগমও তাঁদের সঙ্গে থাকেন।
মা আয়েশা আক্তার বলেন, ‘বখাটেদের কারণে আমার মেয়েটা মারা গেল।’ লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল ঋতুর। এ কারণে কষ্টের মধ্যেও মেয়েটিকে স্কুলে পড়ানো থেকে শুরু করে কোচিংও করাতেন তাঁরা।
ছোট বোন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মিতু বলে, ‘আপু লেখাপড়া শিখে শিক্ষক হতে চেয়েছিল। কিন্তু বখাটে শিমুল আপুকে মেরে ফেলল।’