শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > গ্যালারীর খবর > বাগেরহাটে বিষমুক্ত সবজির বিপ্লব!

বাগেরহাটে বিষমুক্ত সবজির বিপ্লব!

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ ঘেরের পাড়ে সবজি চাষ শুরু হয়েছিল ‘সাথী ফসল’ হিসেবে। কিন্তু, সেই সাথী ফসলই এখন মূল ফসলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে সমানে সমান।

অন্যদিকে, কৃষকের কাছেও পেয়েছে ‘চাকুরে ছেলে’র মর্যাদা।

ঘেরের আইলে গোড়া, ছাউনি পানির ওপর, পানিতে মাছ। তাই, ক্ষেতে বিষ দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে, ঘেরে উৎপাদিত সবজি বলা যায়, পুরোটাই বিষমুক্ত। আর এই বিষমুক্ত সবজির চাহিদাও তাই দেশজুড়ে।

৩ থেকে ৫ টাকা কেজিতে বিষমুক্ত শসা, ৮ থেকে ১০ টাকা কেজিতে করলা, ১০ থেকে ১২ টাকা দরে প্রতিটি লাউ এখানকার বাজারে পাইকারি বিক্রি হয়।

কৃষকের অভিযোগ, ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না তারা। এখানকার শসা, করলা ঢাকা চট্টগ্রামের ভোক্তারা কিনছেন ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি দাম দিয়ে। অবশ্য, পাইকারদের দাবি, ফেরিঘাটের দুর্নীতি, পুলিশের চাঁদাবাজি এবং অতিরিক্ত ট্রাক ভাড়া দিতে গিয়েই বাড়ছে সবজির দাম।

সরেজমিন দেখা গেছে, কয়েক বছরের ব্যবধানে বাগেরহাটে উৎপাদিত সবজি এখন প্রতিবেশী জেলাগুলোর চাহিদা মিটিয়ে বাজারজাত হচ্ছে রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশে। জেলার বিভিন্ন পাইকারি বাজার থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক সবজি নিয়ে যাচ্ছেন পাইকাররা।

এদিকে, এ সবজি বিক্রিকে কেন্দ্র করে এখানকার কয়েকটি বাজার এখন বেশ জনপ্রিয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বড় পাইকারদের কাছে। এছাড়াও সবজিচাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আরো কিছু সহযোগী পেশা।

পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর, পোলেরহাট এবং সিঅ্যান্ডবি বাজারে হাটবারের দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি সবজির আমদানি হয়। আর এ হাটবারকে কেন্দ্র করে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাইকারি সবজির ক্রেতারা আসেন এখানে।

পোলেরহাট এবং সিঅ্যান্ডবি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার সাধারণ কৃষকরা (সবজি উৎপাদকরা) যে যার মতন করে তাদের উৎপাদিত সবজি নিয়ে আসছেন বাজারগুলোতে। আর হাটবারকে কেন্দ্র করে এদিন এসব বাজারে পাইকারি ক্রেতাও থাকেন প্রচুর।

মূলত, ঘের ব্যবসা বা মাছ চাষই এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর এখন প্রধান পেশা। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদাকে পুঁজি করে আশির দশকে এ অঞ্চলে বাণিজিকভাবে চিংড়ি চাষ শুরু হলেও বর্তমানে এখানকার ফসলি জমিগুলো এক প্রকার গ্রাস করে নিয়েছে চিংড়ি চাষ। ফলে, দিন দিন অন্যান্য ফসলের মতো বাগেরহাট হয়ে পড়েছে কৃষি আমদানির জেলায়। আবার অনেক এলাকায় চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে লবণাক্ততা বেড়ে হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

এরই মাঝে বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ, বারইপাড়া, রাখারগাছি, খানপুর, যাত্রাপুর ইউনিয়নের চিংড়ি এবং সাদা মাছ চাষীরা গত কয়েক বছর ধরে তাদের ঘেরের আইল (পাড়ে) শুরু করেন, লতাজাতীয় সবজি চাষ। পাড়ে গাছ লাগিয়ে ঘেরের উপরে মাচা করে একই সঙ্গে মাছ এবং সবজি উৎপাদন করে লাভবান হতে থাকেন তারা।

এইসব চাষীদের সফলতা দেখে দ্রুত এলাকার অন্যান্য কৃষকেরাও শুরু করেন এই পদ্ধতিতে সবজি আবাদ। এভাবেই সারা জেলায় সাধিত হয় সবজি বিপ্লব।

পোলেরহাট বাজারের ইজারাদার আব্দুল জলিল বাংলানিউজকে বলেন, শুধুমাত্র প্রতি হাটবারের দিন বাজারে আসা সবজি পরিবহনের জন্য বস্তাবন্দি এবং ট্রাকে ওঠানোর জন্য এখানে ১৫০ থেকে ২০০ শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সপ্তাহে শনি ও বুধবার পোলেরহাট বাজারে হাট বসে। এমনি করে শুক্রবার ও সোমবার সিঅ্যান্ডবি বাজার এবং বৃহস্পতি ও রোববার বারাকপুর বাজারও কাজ করেন এসব শ্রমিক। এছাড়া ক্ষেত থেকে এসব সবজি বাজারে আনাসহ অন্যান্য কাজেও গড়ে উঠেছে আর একটি পেশাজীবী শ্রেণী।

পোলেরহাট ইজারাদার আব্দুল জলিলে কাছে জানতে চাওয়া হয়, কীভাবে এখানে পাইকার বা কৃষকের কাছ থেকে মাসুল আদায় করা হয়।

বাংলানিউজকে তিনি জানান, শতকরা ৫ টাকা হারে কেবল কৃষকদের কাছ থেকে এখানে টাকা নেওয়া হয়। পাইকারদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।

তিনি জানান, প্রতি হাটবার এ বাজার থেকে সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ২০ ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রির উদ্দেশে যাচ্ছে। এখানকার হাটে সর্বনিম্ন ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকার সবজি বিক্রয়। আর বাজার ভালো হলে এসব হাটে দিনে ২০ থেকে ২২ লাখ টাকার সবজি বিক্রি হয়।

সিঅ্যান্ডবি বাজারে সবজি পরিবহনে শ্রমিকের কাজ করা শ্রীঘাট এলাকার হাবিবুল্লাহ শেখ বাংলানিউজকে জানান, সপ্তাহে ছয়দিন তিনি এই হাটে আসা সবজি বস্তায় পুরে সেলাই ও ট্রাকে লোড করার কাজ করেন। এখানে মূলত ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজ। প্রতিদিন কাজের ওপর ৩৩০ থেকে ৪৫০ টাকা পান তিনি।

ওই বাজারের আরেক শ্রমিক মো. হাবিবুল্লা বাংলানিউজকে বলেন, যেদিন বাজারে সবজি বেশি আসে, সেদিন আমরাও বেশি টাকা বেতন পাই। যেদিন যেমন কাজ হয়, তার ওপর পাইকাররা আমাদের বিল (টাকা) দেন।

সিঅ্যান্ডবি বাজারে ওলিয়ার রহমান নামে স্থানীয় এক পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, আমার নিজেরও ঘের আছে। সেখানেও সবজি চাষ করছি। প্রথম দিকে এ বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসতাম। ব্যবসা ভালো হওয়ায় নিজেই পুঁজি খাটিয়ে এখন পাইকারি সবজি কিনে ঢাকায় পাঠাই।

তিনি জানান, এখানের সব সবজিই উৎপাদিন হয় ঘেরের উপর মাচা করে। আর নিচের পানিতে মাছ চাষ। তাই, কোনো কৃষকই তার ঘেরে উচ্চ মাত্রার কোনো কেমিক্যাল বা কীটনাশক ব্যবহার করেন না। আর এজন্য ঢাকা, চিটাগাং, কুমিল্লাসহ অন্যান্য বাজারগুলোতে এখানকার সবজির চাহিদাও বেশি।

নাটোরে ব্যবসায়ী মো. ফিরোজ বাংলানিউজকে জানান, তিনি এখান থেকে মাল কিনে চট্টগ্রামের পাইপারি বাজারে বিক্রি করেন। এখানকার উৎপাদিত সবজির মান ভালো। প্রতি হাটে তিনি ৩/৪শ মণ সবজি কেনেন।

তিনি জানান, পরিবহনে প্রচুর খরচ পড়ছে তাদের এক ট্রাক সবজি চট্টগ্রাম পর্যন্ত পরিবহনের জন্য। এ জন্য ২৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা গুণতে হয় তাদের।

গাজীপুরের আরেক পাইকার আলিয়র রহমান বাংলানিউজকে জানান, বর্তমানে এক ট্রাক সবজি পরিবহনের জন্য বাগেরহাট থেকে ঢাকা বা গাজীপুরে নিতে খরচ হয় ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা। এখানকার তিনটি বাজার থেকে গড়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাক ভর্তি হয়ে সবজি যায় ঢাকায়।

তার মতে, মাওয়ায় ফেরির পারাপারের জন্য অনেক সময় বিলম্ব হয় সবজি গন্তব্যে পৌঁছাতে; যার জন্য লোকসানও গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের।

পদ্মা ব্রিজ হলে এ অঞ্চলের সবজির বাজার আরো বাড়বে জলে জানান তিনি।

উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজরজাত করতে পারার আনন্দ থাকলেও বর্তমানে তার তাদের উৎপাদিত শসা, খিরাই, লাউ, পটল, উচ্ছে, করলা, মিষ্টি কুমড়া, টমেটোসহ কৃষি পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ এখানকার কৃষকদের। পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কোনো ধরনের সাহায্য না পাওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের।

সদর উপজেলার উত্তর খানপুর এলাকার কৃষক হালিম ফকির বাংলানিউজকে জানান, প্রথমে অল্প কয়েক জন তাদের ঘেরে মাছের পাশাপাশি সবজি চাষ শুরু করেন। কিন্তু বর্তমানে এ অঞ্চলের প্রতিটি ঘেরেই মাছের পাশাপাশি সারা বছরই বিভিন্ন সবজির চাষ হয়। তবে বর্তমানে উৎপাদন খরচ বাড়লেও আগের মতন ভালো দাম পান না তারা।

তিনি বলেন, ঈদের আগে কিছুটা দাম পেলেও চলতি হাটে মাত্র পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টাকা করে প্রতি কেজি শসা বিক্রি করেছি; যা উৎপাদন খরচের তুলনায় খুবই নগন্য।

দক্ষিণ খানপুর এলাকার কৃষক আলতাফ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, তারা তাদের উৎপাদিত সবজিতে কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করেন না। ঘেরে মাছ চাষের কারণে পোকা-মাকড় দমনের প্রয়োজনে কোনো ওষুধ দিতে হলেও খুব উচ্চ মাত্রার কোনো কীটনাশক ব্যবহার করেন না তারা।

সদর উপজেলা সুগন্ধী এলাকার ঘের মালিক মিঠুন নন্দী বাংলানিউজকে জানান, নয় বছর ধরে তিনি আড়াই বিঘা জমিতে মাছ চাষ করছেন। আর সাড়ে তিন বছর ধরে মাছ চাষের পাশাপাশি ঘেরের পাড়ের আইলে সবজি আবাদ করছেন।

তবে কখনো কোনো কৃষি কর্মকর্তা বা কৃষি অফিসের মাঠকর্মীদের মাঠে না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার।

মিঠুন নন্দী জানান, তারা খুব একটা কোনো ধরনের রাসায়নিক বা কেমিক্যাল ব্যবহার করতে চান না। তবে, ওষুধ কোম্পানির লোকেরা বিভিন্ন সময় এসে তাদের নানা ধরনের ওষুধ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেন।

কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে না এলেও কোনো রোগ-বালাইয়ে ওষুধ ও বীজ কোম্পানির এসব মাঠকর্মীরা তাদের ওষুধ বিক্রির জন্য কৃষকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন।

একই এলাকার চাষী মো. রিয়াজ হাওলাদার বাংলানিউজকে বলেন, বেশির ভাগ কৃষক বা চাষীরা শিক্ষিত নন। তারা ক্ষতিকর কেমিক্যাল বা ওষুধ চেনেন না। তাই, বিভিন্ন সময় ওষুধ বিক্রেতা ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাঠকর্মীদের মাধ্যমে কেউ কেউ না বুঝে ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করে ফেলেন। তবে মাচার নিচের পানিতে মাছের চাষ হওয়াতে কেউই উচ্চ মাত্রার কোনো ওষুধ ব্যবহার করেন না।

ওষুধ ও বীজ কোম্পানির খপ্পর মুক্ত হয়ে কৃষি অধিদফতরের সহায়তা পেলে এখানকার উৎপাদন আরো বাড়বে বলে মনে করেন স্থানীয়রা কৃষকেরা।

এ ব্যাপারে জেলা কৃষি অফিসের (খামার বড়ি, বাগেরহাট) উপপরিচালক হীরেন্দ্র নাথ হাওলাদার বাংলানিউজকে জানান, সম্প্রতি, বাগেরহাটে মৎস্য চাষীরা তাদের ঘেরের পাড়ে প্রচুর পরিমাণে সবজি উৎপাদন করলেও তারা ভালো দাম পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা না গেলে কৃষকেরা এসব সবজি উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই, উৎপাদন ধরে রাখার স্বার্থে কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা দরকার।

এজন্য বাজার সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষগুলোর কাজ করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ ও বাগেরহাট সমন্বিত কৃষি প্রকল্পের আওতায় কৃষি অধিদফতরের বিপন্ন বিভাগের অধীনে একটা প্রজেক্ট গ্রহণ করা হচ্ছে। এর আওতায় বাগেরহাটের প্রধান তিনটি কৃষি পণ্যের ‘ল্যান্ডিং স্পেস’ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।

তাছাড়া, কৃষি অধিদফতর সবসময় নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং কৃষি আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে কৃষকের সঙ্গে সর্বদা কাজ করছে।

কৃষি অধিদফতরের মাঠকর্মীদের এসব সবজি উৎপাদকরা সবসময় কাছে পায় না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলানিউজকে হীরেন্দ্র নাথ হাওলাদার জানান, তাদের মাঠকর্মীরা কৃষকের কাছে যান না এটি ঠিক নয়। ওই এলাকাতে কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন সময় তারা একাধিক মাঠ সভা, উঠান বৈঠক করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরাও তাদের অনেক সমস্যা এবং প্রয়োজনের কথা জানান। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাছ চাষের পাশাপাশি এসব কৃষি উদ্যোগে তারা তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন।

আর কৃষকের কাছে বীজ ব্যবসায়ী এবং ওষুধ কোম্পানির মাঠকর্মী ও স্থানীয় কমিশন ভোগীকারী বিক্রেতাদের দৌরাত্ম্যের কথা অস্বীকার না করলেও তাদের এসব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন বলে স্বীকার করেন তিনি।

তবে কৃষি অধিদফতরের একার পক্ষে তা নিয়ন্ত্রণ বেশ কষ্টসাধ্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি।