বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ ঢাকা: রাজধানীতে রেলক্রসিং আছে মোট ৫৮টি। এর মধ্যে ৩৫টি বৈধ, ২৩টি অবৈধ। বৈধ রেলক্রসিংগুলোতে ট্রেন অতিক্রম করার সময় অন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। বেশির ভাগ ক্রসিংয়ে দিনে কমপক্ষে ৭ মিনিট করে ১১৪ বার গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়। আর অবৈধগুলোর এ রকম কোনো হিসাব নেই। রেলক্রসিংয়ে নগরবাসীর কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন পুড়ছে ১৮ লাখ টাকার বাড়তি জ্বালানি।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে রাজধানীতে উড়াল সেতু-উড়াল সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয় ৯ বছর আগে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রথম উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয় মহাখালী রেলক্রসিংয়ের ওপর। ২০০৫ সালে চালু হওয়া এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয় ১১৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এরপর একে একে মহানগরীতে খিলগাঁও, যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান, কুড়িল, বিমানবন্দর সড়ক-মিরপুর, বনানী, তেজগাঁও-বিজয় সরণি অংশে উড়াল সেতু নির্মাণের পর চালু করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন, রাজউক ও সওজ অধিদপ্তরের অধীনে এসব উড়াল সেতু (ফ্লাইওভার ও ওভারপাস) নির্মাণে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৮৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া এলজিইডির অধীনে নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
চলতি বছর সেতু বিভাগের অধীনে ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা উড়াল সড়কের (এলিভেটেড এঙ্প্রেস ওয়ে) কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। এতে ব্যয় হবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। পিপিপি ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। নির্মাণের পর টোল আদায় করে ব্যয় ও লাভ তুলে নেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। সেতু বিভাগের উদ্যোগে বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত অংশে নির্মাণ করা হবে দ্বিতীয় ঢাকা উড়াল সড়ক। এতে ব্যয় হবে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এটিও বাস্তবায়ন করা হবে পিপিপিতে।
তবে ভিন্নমত আছে গবেষকদের মধ্যে। অনেকের মতে, উড়াল সেতু-সড়কের মাধ্যমে উপকার ভোগ করতে পারে মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ। তা ছাড়া এসব সেতু-সড়ক যানজট থেকে মুক্তি নয়, বরং যানজট স্থানান্তর করতে পারে মাত্র। কিছু গবেষক বিকল্প প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছেন।
উড়াল স্বস্তি : রাজধানীর উত্তরা-মহাখালী অংশ এখন ‘উড়তে উড়তেই’ পার হওয়া যায়। উত্তরা থেকে কাকলী অংশ ও বিমানবন্দর সড়ক থেকে মিরপুর অংশে এখন আর যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হচ্ছে না। এই স্বস্তি এনে দিয়েছে বনানী, কুড়িল ও মিরপুর-বিমানবন্দর সড়ক উড়াল সেতু। বনানী উড়াল সেতু চালু হওয়ায় মিরপুরের সঙ্গে উত্তরা, বারিধারা ও রামপুরার যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি এসেছে। কুড়িল উড়াল সেতু চালুর কারণে রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমের যোগাযোগব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে গেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট কুড়িল উড়াল সেতু চালু হয়। এর আগে ২০১২ সালের ২৭ ডিসেম্বর চালু হয় বনানী উড়াল সেতু। গত বছর মেয়র হানিফ উড়াল সেতু আংশিক চালু হয়েছে।
বনানী উড়াল সেতু উদ্বোধনের পর বনানী রেলক্রসিংয়ে কোনো যানবাহনকে আর থেমে থাকতে হচ্ছে না। আগে প্রতিদিন ৭২টি ট্রেন এই ক্রসিং দিয়ে যাতায়াতের সময় অন্য যানবাহনগুলোকে প্রতিবার পাঁচ থেকে ১০ মিনিট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীর ছয় থেকে আট ঘণ্টা এই সিগন্যালেই অপচয় হতো। উড়াল সেতুটি জিয়া কলোনির সঙ্গে যোগ হওয়ায় মিরপুর, ক্যান্টনমেন্ট, মাটিকাটা, মানিকদিসহ আশপাশের এলাকার মানুষ এখন সহজেই মিরপুর থেকে বিমানবন্দর, উত্তরা, বারিধারা, গুলশান, রামপুরা ও পূর্বাচল এলাকায় যাতায়াত করতে পারছে।
এ ছাড়া রাজধানীর শান্তিনগর থেকে মাওয়া পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আরো একটি উড়াল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা। এ প্রকল্প এখনো অনুমোদন হয়নি। শান্তিনগর থেকে পল্টন হয়ে গুলিস্তানের গোলাপ শাহ মাজার পার হয়ে মেয়র হানিফ উড়াল সেতুর ওপর দিয়ে বংশাল হয়ে বাবুবাজার ব্রিজের পাশ দিয়ে সেতুটি যাবে। গত বছরের ৯ জানুয়ারি অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে সেতুটি পিপিপি ভিত্তিতে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৭ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর যানজট নিরসনে উড়াল সেতু ও উড়াল সড়ক নির্মাণের জন্য নেওয়া এসব প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে আরো উড়াল সেতু ও সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। পিপিপি ভিত্তিতে এসব সেতু-সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী নির্মাণ ব্যয় তুলে নিয়ে যায় টোল আদায় করে। সরকারকেও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগের একটি অংশ দিতে হয়। এ জন্য মেয়র হানিফ উড়াল সেতু ব্যবহারকারীদের মাসুল গুনতে হচ্ছে। এ মাসুলের হার নিয়ে আপত্তি রয়েছে। ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যে হারে টোল নেওয়ার চুক্তি ছিল, এখন আদায় করা হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। বেসরকারি খাতের নির্মাণ সংস্থাটির যুক্তি, এগারো বছর আগে ধার্য করা হার এখন অচল। অবশ্য রাজধানীর অন্য কয়েকটি উড়াল সেতু সরকারি ব্যয়ে তৈরি। ফলে বিনা খরচেই এগুলোর সুফল ভোগ করছে ব্যবহারকারীরা।
গবেষকদের ভিন্নমত : তবে রাজধানীজুড়ে এই যে উড়াল সড়কের অন্তর্জাল বিস্তৃত হচ্ছে, এর সুফল বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কতখানি পাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে গবেষকদের। তাঁদের গবেষণায় উঠে এসেছেথঢাকায় উড়াল সেতু ও উড়াল সড়ক ব্যবহারে উপকৃত হতে পারে মাত্র ১৭ শতাংশ যাত্রী। রাজধানীতে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে চলাচলকারী যাত্রী বেশি। উড়াল সড়ক ব্যবহার করে বেশি দূরত্বে যাওয়ার প্রয়োজন নেই তাদের। এ ছাড়া গণপরিবহন চলাচলের জন্য উড়াল সড়ক বা সেতু মানানসই নয়।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকৌশলী সন্তোষ কুমার রায় ও সৈয়দ আসলাম আলী তাঁদের এক গবেষণাপত্রে রাজধানীর ৭৩টি ইন্টারসেকশনে আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণের পাশাপাশি সমন্বিত গার্মেন্ট পল্লী, যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট নির্ভরতা বাড়ানো, কমলাপুর রেলস্টেশন জয়দেবপুরে স্থানান্তর, বাস র্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি বা মেট্রোরেল চালুর সুপারিশ করেছিলেন। দুই গবেষকের মতে, রাজধানীতে সিগন্যাল, ডানে-বাঁয়ে মোড়, ইউটার্নের মতো নানা কারণে গাড়ির গতি ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ছে যানজট। তবে সিগন্যাল তুলে দিয়ে ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ করে গাড়ির বিরামহীন চলা নিশ্চিত করা সম্ভব।
গবেষক সন্তোষ কুমার রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, উড়াল সেতু নির্মাণে যানজট স্থানান্তর হয়ে থাকে মাত্র। যেমন মহাখালী উড়াল সেতু হওয়ার পর যানজট স্থানান্তরিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এসে তীব্র রূপ নিয়েছে। বনানী উড়াল সেতু চালুর পর এখন যানজট স্থানান্তর হয়ে প্রকট রূপ নিয়েছে কাকলীতে।
বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণায়ও উঠে এসেছে একই রকম চিত্র। এতে বলা হয়েছে, মাত্র ১৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী ফ্লাইওভার বা উড়াল সেতু ব্যবহার করে উপকৃত হবে। বাকি ৮৩ শতাংশ মানুষকে যানজট থেকে রেহাই দেওয়া সম্ভব হবে না। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক, পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সারোয়ার জাহান কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে খুব কম যাত্রীর গন্তব্য আছে। বেশির ভাগের গন্তব্য এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে। এ জন্য বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা উড়াল সড়ক নির্মাণ হলে গণমানুষ উপকৃত হবে না। বরং যানজট বাড়বে। মেয়র হানিফ উড়াল সেতু চালুর পর এটির ওপর দিয়ে খুব কমসংখ্যক গণপরিবহন চলাচল করছে। সেতুর নিচ দিয়ে আগের মতোই গাড়ি চলাচল করছে। সেখানে যানজট নিরসন হয়নি। এই সেতু ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার ক্ষেত্রে একটু সুবিধা ভোগ করা সম্ভব হবে। তবে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে ঢুকে আবার তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে মানুষকে।
ঢাকা উড়াল সড়ক : অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া ঢাকা উড়াল সড়কের কাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেতু বিভাগের এই প্রকল্পের ভৌত কাজ থেমে আছে। চলতি বছর কাজ শুরু হলে তা ২০১৬ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রকল্পে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর আওতায় বিমানবন্দর সড়ক থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হবে। প্রথম ধাপে বিমানবন্দর সড়ক থেকে মহাখালী পর্যন্ত আট কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে মহাখালী থেকে কমলাপুর ও তৃতীয় ধাপে কমলাপুর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, টোল দিয়ে এই উড়াল সড়ক ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়িতে ১২৫ টাকা, বাসের জন্য ২৫০ ও ছয় চাকার ট্রাকে ৫০০ টাকা টোল ধরা হয়েছে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১৩ হাজার ৫০০ যানবাহন চলাচল করবে এই সড়কে। পর্যায়ক্রমে তা ৮০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিমানবন্দর সড়ক থেকে শুরু হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত বিদ্যমান রেললাইনের ওপর দিয়ে নির্মিত হবে এটি। কমলাপুর থেকে অতীশ দীপঙ্কর সড়কের ওপর দিয়ে তা সায়েদাবাদ পর্যন্ত যাবে। পরের অংশটি মেয়র হানিফ উড়াল সেতুর ওপর দিয়ে যাত্রাবাড়ী অতিক্রম করে কুতুবখালী পর্যন্ত যাবে।
ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক : আশুলিয়া ও ইপিজেড এলাকা থেকে রপ্তানিযোগ্য পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা তীব্র যানজট। এই যানজট নিরসনের জন্য সেতু বিভাগ ঢাকা-আশুলিয়া উড়াল সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বিমানবন্দর থেকে আশুলিয়ার নবীনগর হয়ে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই উড়াল সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি গ্রহণ করা হবে পিপিপি পদ্ধতিতে। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য এ পর্যন্ত সাতটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ প্রকাশ করেছে। (কালের কন্ঠ)