রবিবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৭ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৮ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা

চ্যালেঞ্জের মুখে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ ৯ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এ কারণে বাড়ছে না জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও। আর এসব সংকট থেকে উত্তরণ না হলে বাংলাদেশের মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া বিলম্বিত হতে পারে।

বাংলাদেশের শিক্ষার ওপর সম্প্রতি সমীক্ষা চালায় বিশ্বব্যাংক মিশন। এর আগে একাধিকবার সমীক্ষা চালিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। উভয় সমীক্ষা থেকে শিক্ষার এ চ্যালেঞ্জগুলো বেরিয়ে এসেছে।

সমীক্ষায় উঠে এসেছে, শিক্ষার এ বাধাগুলোর প্রায় সবগুলোই দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃতির। সেজন্যই দু’দশক ধরে চলমান ‘উপবৃত্তি’ কর্মসূচিও এ বাধা পেরোতে সুফল আনতে পারেনি। যে কারণে স্কুলে ভর্তি বাড়লেও ঝরে পড়ার হার কমছে না। একইভাবে শিক্ষার মানেও পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।

শিক্ষার চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- অদক্ষ শিক্ষক, নিম্নমানের শিখনপদ্ধতি, ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি, অপ্রতুল বরাদ্দ, শিক্ষার্থীর উদ্বাস্তু হওয়া, স্কুলের অপ্রতুলতা, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতি ও দারিদ্র্য।

বলা হচ্ছে, স্কুলগমন উপযোগী অনেক শিক্ষার্থী মূলত দারিদ্র্যের কারণে এখনও স্কুলের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেশি। জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় দেশে স্কুলের সংখ্যাও কম। এই দুটি সমস্যাই বেশি মোকাবেলা করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকের মানও অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক শিক্ষকেরই তেমন প্রশিক্ষণ নেই। পড়ানোর বিষয় সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের পর্যাপ্ত দক্ষতা না থাকায় শিক্ষার্থীর শিখনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এর বাইরে শিখনমাত্রাও নিচু মানের। এ কারণে যেসব শিক্ষার্থী ভালোভাবে শিখতে পারছে না, নিরুৎসাহিত হয়ে তাদের অনেকেরই ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটছে। আর ঝরে পড়ার পর তারা সাধারণত অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে ঢুকে পড়ে।

বাংলাদেশের শিক্ষার আরেকটি দুর্বল দিক হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি। অনেকটা মুখস্থ নির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি বহাল রয়েছে। শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতি এবং মান পরিমাপকের অভাবজনিত কারণেও শিক্ষার্থীরা কার্যকর দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বিগত চার বছরে কমছেই। এটাও শিক্ষার একটা চ্যালেঞ্জ।

দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিক্ষার্থী তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে শহরে যায় ও বস্তিতে বসবাস করে। এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই আর শিক্ষাজীবনে ফিরতে পারে না। স্কুলগুলোতে বড় সমস্যা ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। একদিকে ধনী শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভালোভাবে যতœ নেয়া হয়। বাড়িতেও বাড়তি যতœআত্তি পান তারা। এর বাইরে শহর-গ্রামের স্কুলের মধ্যেও বৈষম্য রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার ফলে যার প্রমাণ মেলে।

রাজধানীতে ৩ মার্চ এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ মানসম্মত শিক্ষার অভাবের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি একমত যে, বিদ্যালয়ে আমাদের ভর্তি বেড়েছে। কিন্তু মান ততটা এগোয়নি। আমাদের লক্ষ্য শিক্ষার মান বিশ্বমানে উন্নীত করা। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা ও পরামর্শ সাদরে গৃহীত হবে।’

তবে অনেকটা দ্বিমত পোষণ করেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শ্যামল কান্তি ঘোষ। তিনি বলেন, লার্নিং অ্যাচিভমেন্ট ইভালুয়েশনের’ (শিক্ষা অর্জনের পর্যায় মূল্যায়ন) বিষয়টি বলা হচ্ছে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য কেউ ইংরেজি দক্ষতার (আইইএলটিএস) পরীক্ষা দিয়ে নয়টি স্তরের (ব্যান্ড-৯) মধ্যে ষষ্ঠ স্তর (ব্যান্ড-৬) পেলে তাতে সে ইংরেজিতে দক্ষ নয় বোঝায় না। অস্ট্রেলিয়াকেন্দ্রিক সংস্থা এসিইআরের মাধ্যমে সমীক্ষায় তারা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের যে বিষয়টি বের করেছেন সেটির মাধ্যমে কে কতটা দক্ষতামান অর্জন করল সেটাই বের করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘তবে শিক্ষার্থীদের বর্তমান দক্ষতা মানে আমরাও সন্তুষ্ট নই। আমরা শিক্ষার্থীদের শতভাগ দক্ষতা দেখতে চাই।’

সংশ্লিষ্টদের মতে, শিক্ষকদের কর্মতৎপরতা, দায়বদ্ধতা, পরিকল্পনা এবং অধ্যবসায়সহ বিভিন্ন দিক সঠিকভাবে নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মান বাড়বে। এ কৌশলগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের শিক্ষায় অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বাড়বে। নইলে শিক্ষায় অংশগ্রহণ আর ভর্তিতে যে বিপ্লব এসেছে সেই ‘অদম্য মনোবল’ আর অটুট থাকবে না।

বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলছে, দারিদ্র্যের কারণে এখনও প্রায় ৫০ লাখের বেশি শিশু স্কুলের বাইরে থেকে গেছে। এদের একটি বড় অংশ শহরের বস্তিতে অথবা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাস করে। যেসব শিশুর পরিবার সদ্য বস্তিতে এসে উঠেছে তাদের মধ্যে ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি। এসব শিশুকে চাহিদাকেন্দ্রিক (দারিদ্র্য ও শিখনের অসুবিধা) সমস্যার পাশাপাশি সরবরাহকেন্দ্রিক (ধারে কাছে পর্যাপ্ত স্কুলের অভাব) সীমাবদ্ধতার মোকাবেলা করতে হচ্ছে। স্কুলের বাইরে থাকা এবং ভর্তি হতে না পারার ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আরও বলা হয়, প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সংখ্যা বাড়ছে, তবে এটা মাত্র ২৩ ভাগ। কাক্সিক্ষত দক্ষতা অর্জন না করায় এখনও প্রথম শ্রেণীতে ৭ এবং পঞ্চম শ্রেণীতে ১০ ভাগ শিক্ষার্থী পুনরাবৃত্তির শিকার হয়ে থাকে। অনেকে শুরুতেই ঝরে পড়ে। ২৪ ভাগ শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণী পাসের পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। প্রতি ১০ জন প্রাথমিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭ থেকে ৮ জন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে পারে, ৬ থেকে ৭ জন ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত যেতে পারে আর ৫ জন দশম শ্রেণীর কোটায় পৌঁছতে পারে এবং মাত্র ৩ থেকে ৪ জন কোনো শ্রেণীতে পুনরাবৃত্তি না করে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর গন্ডি পেরিয়ে যেতে পারে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বিগত ৪ বছরে বাজেট বরাদ্দ ক্রমাগত কমছে। উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে ২০১০-১১ অর্থবছরে বাজেটের মোট ব্যয়ের ১৩ দশমিক ৯ শতাংশই বরাদ্দ ছিল শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে। আরও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু আগামী ১০ বছরে উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে মাধ্যমিক, কারিগরি, বৃত্তিমূলক, উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, স্কুলে শিখন আর শিক্ষকের মান। শিক্ষকের জ্ঞানের স্বল্পতা থাকলে শিক্ষার্থীর শিখনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। শিক্ষক সনাতনী পদ্ধতিতেই মুখস্থ পড়ান। পড়ানোর বিষয়ে তাদের জ্ঞানের অপ্রতুলতা শিক্ষার্থীদের শেখার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিক্ষকদের মননগত ও আচরণগত দক্ষতার মজবুত ভিত গড়ে তোলার সুপারিশ করে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, পঞ্চম শ্রেণীতে এখনও ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী বাংলায় আর ৬৭ ভাগ শিক্ষার্থী গণিতে এবং অষ্টম শ্রেণীতে বাংলায় ও ইংরেজিতে ৫৪ এবং গণিতে মাত্র ৬৫ জন কাক্সিক্ষত দক্ষতা অর্জন করে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, বেসরকারি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দেয়া এমপিও ব্যবস্থা পর্যালোচনা করা দরকার। দেশের ৯৭ ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি। বিপরীত দিকে ৯৭ ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারি। যেহেতু এমপিও প্রথা রয়েছে, তাই এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কিভাবে সরকারি বিদ্যালয় বৃদ্ধি করা যায়, সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। আর রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক স্তর সমাপন শেষে একজন শিক্ষার্থীর ৫০টি দক্ষতা মান অর্জন করার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে মাত্র ১৯টি দক্ষতা মান অর্জন করে বলে সরকারিভাবে সমীক্ষায় বের করা হয়েছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া দরকার। তিনি বলেন, সরকার সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে না। সেটি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে হবে।