শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > রাজনৈতিক হত্যা আতঙ্ক বাংলাদেশে

রাজনৈতিক হত্যা আতঙ্ক বাংলাদেশে

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে। জাতীয় সংসদের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে এ হত্যাকাণ্ড। এতে সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীরা তাদের জীবন নিয়ে আতঙ্কে। অনলাইন আল জাজিরায় প্রকাশিত ‘পলিটিক্যাল কিলিংস সেপ্রড ফিয়ার ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে যে, সরকার যদি ঘাতকদের বিচারে দ্রুত পদক্ষেপ না নেয় তাহলে আগামী মাসগুলোতে এ সঙ্কট আরও খারাপ হতে পারে।

ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (এএসকে)-এর তদন্তকারী পরিচালক নূর খান বলেছেন, যে হারে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে তা উদ্বেগজনক। জানুয়ারিতেই ৩৩টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তাদের হিসাবে গত বছর বাংলাদেশে ২ শতাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নূর খান বলেন, এক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টার্গেট করা হয় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের। বিরোধীরা যদি তাদের প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে না পারে তাহলে তারা বিকল্প পন্থা বেছে নিতে পারে। যদি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকে তাহলে বাংলাদেশে সশস্ত্র ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটা অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে। এরই মধ্যে এসব হত্যা বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

এ সংস্থার এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড এডামস বলেন, বার বার একই কথা বলা হচ্ছে যে, অপরাধ সংঘটনের স্থানে আটক ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হলে কোন ভাবে সে গুলিবিদ্ধ হয়। এটা একটি ঠাট্টার বিষয় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ঘটনার শিকার যখন রাজনৈতিক একজন অজনপ্রিয় ব্যক্তি হন তখন এই কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়। ব্র্যাড এডামস বলেন, কর্তৃপক্ষ যখন এমন দাবি করেন তখন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমিক সরকারগুলোর দীর্ঘদিনের ও তথ্যসংবলিত রেকর্ড আছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের, যাকে তারা ক্রসফায়ার বলে থাকে। বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ সবাই নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। ব্র্যাড এডামস হতাশা প্রকাশ করে বলেন, রাজনৈতিক চাপের ঊর্ধ্বে থেকে পেশাগত মনোভাব নিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা উচিত। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর খুব কমই আস্থা থাকবে বাংলাদেশীদের।

ওদিকে গ্রেপ্তারের পরে নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সরকারকে দায়ী করেছেন বিএনপি নেতারা। তারা বলছেন, সরকার বিরোধী নেতাকর্মীদের টার্গেট করেছে। গত দু’ মাসে ক্ষমতাসীন দলেরও বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। ওই রিপোর্টে নিরাপত্তা হেফাজতে মারা যাওয়ার কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। তাদের একজন রবিউল ইসলাম। তাকে গ্রেপ্তার করা হয় ২৭শে জানুয়ারি। যশোরের এক সাংবাদিক সাইফুর রহমান বলেছেন, পুলিশ পরে জানিয়েছে যে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর দু’পক্ষে গুলিবিনিময় হয়। এ সময় রবিউল গুলিবিদ্ধ হন। বিএনপির এই কর্মী অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান নিকটস্থ একটি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে। পুলিশ অভিযোগ করে, রবিউল ইসলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা চৈতন্য কুমার মণ্ডল হত্যায় জড়িত। একদিন আগে ঘটে এ হত্যাকাণ্ড। সারা দেশের চিত্র এই একই। শুধুমাত্র নাম আর স্থানের পরিবর্তন ঘটে। পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, গত মাসে যারা নিরাপত্তা হেফাজতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন তারা নিজেরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত। ৩০শে জানুয়ারি সোনাইমুড়ীতে একই রকম ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন বিএনপির জেলা নেতা তৌহিদুল ইসলাম। এর আগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অধিকার তার জানুয়ারির হিসাবে দেখিয়েছে জানুয়ারিতেই ৩০টির বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর জন্য দায়ী করা হয়েছে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিকে।

এ ঘটনা মাত্র এক মাসের। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, যারা নিহত হয়েছেন তারা হয়তো বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর নেতা না হয় কর্মী ছিলেন। গত মাসে যাদের হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেন আতিকুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রদলের জয়েন্ট সেক্রেটারি। সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলা হয় গত ডিসেম্বরে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয় আতিকুর রহমানকে। ফলে তিনি পালিয়ে থাকেন টাঙ্গাইলে। সেখানে বকুল নামে এক আত্মীয় তাকে আশ্রয় দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ১৩ই জানুয়ারি রাতে কমপক্ষে ৬ জন মানুষ যারা নিজেদের পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্য দাবি করেন, তারা আমার বাড়িতে ঝড়ো গতিতে প্রবেশ করে এবং আতিক ও মহিদুল ইসলাম নামে একজনকে তুলে নিয়ে যায়।

সৈয়দপুর বাইপাস সড়কের কাছে ২০শে জানুয়ারি পুলিশ উদ্ধার করে আতিকুর রহমানের মৃতদেহ। এখনও মহিদুল নিখোঁজ। ওদিকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ২৬শে ডিসেম্বর থেকে ২৭শে জানুয়ারির মধ্যে বিএনপির ৩০২ নেতাকর্মী ও ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে না হয় গুম করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের আতঙ্ক জেঁকে ধরেছে। বিএনপির জয়েন্ট জেনারেল সেক্রেটারি রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাপক সমালোচিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরের দিন ৬ই জানুয়ারি থেকে ক্ষমতাসীন দলের কমপক্ষে ৯ কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে।

বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড হয়েছে বিরোধীদলীয় সমর্থকদের হামলায়। এমন সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার ৩০ বছর বয়সী মাহবুবুর রহমান রানা। ঢাকার মগবাজারে ২৩শে জানুয়ারি তার ওপর হামলা চালায় চার থেকে ৫ ব্যক্তি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, হামলাকারীরা ছিল হেলমেট পরা। তারা অকস্মাৎ রানার ওপর হামলা চালায়। ১৭ই জানুয়ারি নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য ও স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানের ওপর জেলার সিঙ্গরা এলাকায় হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতের আত্মীয়রা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের নিকটজনকে হত্যার জন্য যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা নিরপরাধ।

সাতক্ষীরার বাসিন্দা শামসুন নাহারের স্বামী ক্ষমতাসীন দলের কর্মী আবু রায়হানকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, সমপ্রতি পুলিশ আমাকে জানিয়েছে যে, আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আমার মনে হয় তারা এ হত্যায় জড়িত নয়। ওদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, অপরাধীদের বিচার করা হবে। আওয়ামী লীগের ৯ নেতাকর্মীকে হত্যায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সব চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ও অপরাধীদের মধ্যে গুলি বিনিময়কালে তারা মারা গেছে। তারা সশস্ত্র অপরাধী। পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে গেলে বা তাদের আস্তানা ঘেরাও করলে তারা পুলিশের দিকে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশও গুলি ছোড়ে। এভাবেই অপরাধীদের মৃত্যু হয়। আমার জানামতে তারা সবাই অপরাধী, অনেক মামলায় তারা অভিযুক্ত। (মানবজমিন)