মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন
রাঙ্গামাটি:
নতুন বছরকে বরণ ও পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে রাঙ্গামাটিতে আজ থেকে শুরু হয়েছে পাহাড়িদের প্রধান সামাজিক উৎসব বৈসাবি।
আকাশে ভোরের সুর্যে্যর আলোর উকিঁ দিতে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে আজ ১২এপ্রিল, শনিবার রাঙামাটিতে শুরু হয়েছে বৈসাবি’র মূল আয়োজন ফুল বিঝু। শহরের রাজবাড়ী ঘাট, গর্জনতলী, কেরানী পাহাড় সহ বিভিন্ন স্পটে কাপ্তাই লেকে তীরে এ ফুল ভাসানোর আয়োজন করা হয়।
পাহাড়ের বসবাসরত সকল নৃ—গোষ্টি সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাসে কাপ্তাই হ্রদে পানিতে ফুল ভাসিয়ে গঙ্গাদেবীকে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে দেশ—জাতির মঙ্গল প্রার্থনা করে ফুল বিঝু দিবসের সূচনা করেন। এসব বর্নাঢ্য বর্নিল বৈসাবীর আয়োজনের রঙে রঙিন এখন পর্যটন জেলা রাঙ্গামাটি সহ তিন পার্বত্য জেলা।
চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, এবং ত্রিপুরার বৈসু নামে এ উৎসব পালন করেন। সমতলরে মানুষের কাছে যা বৈসাবি নামে পরিচিত। বৈসাবির আনন্দে মেতেছে পাহাড়ের মানুষ।
উৎসব প্রিয় পাহাড়িরা সারা বছর মেতে থাকেন নানান অনুষ্ঠানে। তবে তার সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় বর্ষবিদায় ও বরণ উৎসব। জাতি ভেদে নানান নামে পালন করলেও বৈসাবি নামে অধিক পরিচিত সমাদৃত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম এই সামাজিক আয়োজনে ব্যস্ত এখন শহর, নগর আর পাহাড়ি পল্লীগুলো। বাংলা বর্ষ বিদায় ও বরণ উপলক্ষে চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সংগ্রাই, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু ও অহমিয়ারা বিহু এভাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে আলাদাভাবে পালন করে এই উৎসব।
উৎসবের প্রথম দিনে পানিতে ফুল ভাসানোর পর বাসায় গিয়ে ফুল আর নিমপাতা দিয়ে ঘর সাজায় তরুণ—তরুণীরা। ছেলেমেয়েরা তাদের বৃদ্ধ ঠাকুরদা—ঠাকুরমা এবং দাদু—দিদাকে স্নান করায় এবং আশীর্বাদ নেয়। চৈত্র মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল পালন করা হয় মূল বিঝু। এদিন পাহাড়িরা বাড়িতে বাড়িতে আয়োজন করেন নানা মুখরোচক খাবার, একে অপরের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া ও প্রীতি বিনিময়ে ব্যস্তদিন অতিবাহিত করেন। এছাড়া এদিন সকালে বুদ্ধমূর্তি স্নান করিয়ে পূজা করা হয়।
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসুক, মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাই এবং চাকমাদের ‘বিঝু’, তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু, অহমিয়ারা বিহু এসব অনুষ্ঠান মিলে বৈসাবি। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি জনগোষ্ঠী নিজেদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাস থেকে নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। প্রতিটি জনগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে জড়িত থাকে তাদের নিজেদের প্রথা ও সংস্কার। চৈত্র মাসের শেষ দুটি দিন এবং বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই তিন দিন অনুষ্ঠান পালন করে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষ। প্রকৃতিই যে জীবনের উৎস, যাপিত জীবনের বাহন, পার্বত্য অঞ্চলের আদি বাসিন্দারা সেটাকে অস্বীকার করেনি কখনো। আর সেটা করেনি বলেই এই জনগোষ্ঠীগুলোর প্রতিটি অনুষ্ঠানে প্রকৃতির ছোঁয়া থাকে স্বাভাবিকভাবে। এ জন্য বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিঝু অনুষ্ঠানে ফুলের ব্যবহার চোখে পড়ে লক্ষ্যনীয় ভাবে। চোখে পড়বে প্রকৃতি পূজার বিভিন্ন প্রথা। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বৈসুকের প্রথম দিনের নাম হারি বৈসু, মারমাদের সাংগ্রাই অনুষ্ঠানের প্রথম দিনের অনুষ্ঠানের নাম সাংগ্রাই আক্যা বা পাইং ছোয়ায় এবং চাকমাদের বিঝুর প্রথম দিনের নাম ফুল বিঝু। প্রথম দিনগুলো মূলত ফুল সংগ্রহ, বাড়িঘরের পরিষ্কার—পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদিতে কাটানো হয়।
দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দিন থেকে শুরু হয় খাওয়া দাওয়া, অতিথি আপ্যায়নের মূল পর্ব।
এদিন পাহাড়িদের ঘরে ঘরে চলে পাঁজন আতিথেয়তা। বিঝু আর পাঁজন এই দুটি শব্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিভিন্ন সবজি যেমন, আলু, পেঁপে, গাঁজর, বরবটি, তারা, কচু, লাউ, কাঁচকলা, কচি কাঁঠাল, সজনে ডাটা, বন থেকে সংগ্রহ করা আরো বিভিন্ন প্রকারের সবজি কেটে ধুয়ে নিয়ে যে যার মত মসলা, শুটকি মাছ বা চিংড়ি মাছ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী পাঁজন তোন বা তরকারি রান্না করা হয়। ১১টি পদ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪১টি পদ দিয়ে রান্না করা হয় পাঁজন। অনেকে আবার এর চেয়ে বেশি পদও ব্যবহার করেন। এই পাঁজন খেলে শারিরীকভাবে সুস্থ ও রোগ—ব্যাধি মুক্ত থাকা যায় বলে বিশ্বাস করেন পাহাড়ের অধিবাসীরা। তাই বছর শেষে নতুন বছরে সুস্থ থাকার প্রত্যয়েও পাঁজন খাওয়া হয়। বিঝুর দিনে ৭টি বাসায় পাঁজন খাওয়াটা শুভ বলে বিশ্বাস করেন পাহাড়িরা।
নতুন বছরে বিহারে গিয়ে প্রার্থনা করা হয়। এদিন চলে খাদ্য—পানীয়ের মহা উৎসব, সে পাহাড়ে হোক কিংবা সমতলে। এই খাবারের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী খাবার যেমন থাকে, তেমনি থাকে নতুন নতুন পদের খাবারও। বিভিন্ন ধরনের পিঠাও খাওয়া হয় এ সময়। বিন্নি চালের বড়া পিঠা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা—এই তিন জনগোষ্ঠীর অনুষ্ঠান প্রায় একই ধরনের হলেও মারমা জনগোষ্ঠী নববর্ষে পানিখেলা খেলে থাকে। মূলত তরুণ—তরুণীদের অংশগ্রহণে এ পানিখেলা হয়। চাকমারা বড় কোনো গাছ থাকলে তার নিচে প্রদীপ জ্বালিয়ে তাকে সম্মান প্রদর্শন করে জীবন ও প্রতিবেশকে রক্ষা করার জন্য। গৃহপালিত পশুদের বিশ্রাম দেওয়ার রেওয়াজও রয়েছে এদিন। বিঝু উৎসব চলাকালে কোনো জীবিত প্রাণী হত্যা করে না চাকমা সম্প্রদায়। এ সবকিছুই যেন প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ, প্রকৃতি রক্ষা ও তার কাছে ফিরে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা।
মূলত ১২ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বৈসাবির মুল আনুষ্ঠানিকতা হলেও পাহাড়ে বৈসাবি’র আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ঐতিহ্যবাহী খেলাধূলা, মেলাসহ নানান আয়োজনে চলছে বৈসাবি উৎসব। এই উৎসবের রেশ চলে বাংলা নববর্ষের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।
পানিতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসব ১৬ এপ্রিল মারমা জনগোষ্ঠীর জলকেলি’র মাধ্যমে শেষ হবে পাহাড়ের বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা।
গত ৩ এপ্রিল রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়। এছাড়া ৯ এপ্রিল থেকে বিঝু—সাংগ্রাই—বৈসু—বিষু—বিহু—সাংক্রাই
—চাংক্রান—পাতা উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে চার দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, নদীতে ফুল ভাসানোসহ বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে।
এদিকে এ উৎসবকে প্রানবন্ত ও উৎসমূখর পরিবেশে পালন করতে পারে তার জন্য ছিল রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন সহ জেলা আইন শৃঙখলাবাহিনীর ছিল নানান কার্যক্রম ও পদক্ষেপ।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, পাহাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে এবং তাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও উৎসব রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি ও উৎসবের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। বৈসাবি এবং বাংলা নববর্ষ এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের উৎসব। এই উৎসবকে সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে।”
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার বলেন, পার্বত্যাঞ্চলের ১৩টি জনগোষ্ঠী তাদের স্ব স্ব নামে বাংলা বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে থাকে। এই উৎসব ঘিরে এখানকার মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হয়। সাধারণের মাঝে উৎসবের রঙ ছড়িয়ে দিতে জেলা পরিষদ বিভিন্ন অনুদান—উপঠোকন প্রনোদনা প্রদান সহ সাত দিনব্যাপী বিঝু মেলার আয়োজন করেছে।
বৈসাবি শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য , সংস্কৃতি ও মিলন মেলার প্রতীক।
আগামী ১৬ এপ্রিল রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙালহালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মারমা জাতিগোষ্ঠীর সাংগ্রাই জলোৎসব বা জলকেলির মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হবে পাহাড়ের বর্ষবিদায় ও বরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন।