শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > রাজনীতি > শ্রীপুর প্রসঙ্গঃ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত এবং নাগরিক ভাবনা

শ্রীপুর প্রসঙ্গঃ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত এবং নাগরিক ভাবনা

শেয়ার করুন

দুধ বিক্রি করতে দুধওয়ালা রাস্তার পাশে বসে থাকে। দুধ বিক্রি হয়না, ক্রেতা পাওয়া যায়না। মাদকদ্রব্য বিক্রি হয় গোপনে, অথচ ক্রেতার অভাব হয়না। ৯৫ ভাগ মুসলমানের এই দেশে, চিনি কল চিনি উৎপাদনে লস করে প্রতিবছর। অথচ একই প্রতিষ্ঠান মদ উৎপাদন করে বছরে লাভ করছে ৪০০ কোটি টাকা। একই প্রতিষ্ঠান, শুধু মাত্র পণ্যের উৎপাদনে ভিন্নতা এনে লাভবান হচ্ছে। নিঃসন্দেহে সুখের খবর। রাষ্ট্রের জন্য এমন লাভজনক প্রতিষ্ঠান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমাজ এবং রাষ্ট্রের জনগণের কাছে মদের গুরুত্ব কতটুকু তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের মাওনা অঞ্চলে গত ৩০ আগস্ট মধ্য রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সারা দেশে আলোচিত হচ্ছে। সমালোচনার মুখে পড়ছে গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সাথে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নাম যুক্ত। তাই একে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর। তাই প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে সচেতন মহলের নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি।

বিষয়টির গভীরে যাওয়ার পূর্বে, এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির মোড়ল প্রসঙ্গে কিছু বলা প্রয়োজন। সে তৃণমূল থেকে ওঠে আসা এক মেধাবী ছাত্র নেতা। যার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অত্যন্ত গোছানো এবং পরিকল্পিত। এই ঘটনার একদিন পর ১ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী নিয়ে গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ, সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। রাজনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির মোড়লের ভূমিকা শতভাগ প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু ছাত্রলীগের যে মূল কাজ, তা বাস্তবায়নে তার ভূমিকা কতোটুকু সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

প্রায়শই তাকে তামিল সিনেমার হিরোদের ভূমিকায় কক্সবাজারের বেলাভূমিতে দেখা যায়। নিজস্ব নেতাকর্মীদের বিশাল বাহিনী নিয়ে সমুদ্র বিহারে বের হওয়া ছাত্রলীগের অন্য কোনো নেতাকে দেখা যায়না। সেদিক থেকে নাছির মোড়ল একজন বিলাসী ছাত্র নেতা নিঃসন্দেহে। তার এমন বিলাসী কর্মকাণ্ডের জন্য বিশাল অর্থের প্রয়োজন হয়। বিশাল রাজনৈতিক মিছিল কিংবা বিশাল বহর নিয়ে আমোদপ্রমোদ করার জন্য, বিশাল অর্থের জোগান কোথা থেকে আসে সে প্রশ্ন ওঠা অতি স্বাভাবিক! প্রশ্নের উত্তর পাওয়াও জরুরি!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত একটি বিষয়ের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
১ টি বিদেশি অস্ত্র এবং ৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। সাথে ১৩৫ পিস ইয়াবা টেবলেটও পাওয়া গেছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৩ জনকে। গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা সংস্থার চৌকস অফিসার শহিদুল ইসলাম সাহেব তার ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেছেন “শিহাব বাহিনী “র নাম। শিহাব বাহিনী’র শিহাব সহ গ্রেফতার হওয়া হৃদয় শেখ, আনোয়ার হোসেন সহ সবাই গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির মোড়লের হয়ে কাজ করে। শব্দটা “নাসির মোড়ল বাহিনী” হলেই যৌক্তিক হতো বলে করছি।

যাই হোক, তবুও আমরা সন্তুষ্ট। সরাসরি না হলেও, পরোক্ষ ভাবে “শিহাব বাহিনী” র নামটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এই বাহিনীর মদদদাতা কারা, তাও জনগণের কাছে পরিস্কার হয়েছে। শ্রীপুর থানা যখন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থা তখন তাদের হাতে দায়িত্ব তুলে নিচ্ছেন। তাই জেলা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি এখনো আমাদের আস্থা অবিচল। তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

যাদের প্রতি আস্থা তৈরী হয়, তাদের প্রতি প্রত্যাশাও বেড়ে যায়। তাই, গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিও প্রত্যাশা রয়েছে আরও। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে আরও অনেক অস্ত্র উদ্ধার হওয়ার কথা, বিশেষ করে একাধিক অস্ত্র থেকে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে । উদ্ধার করা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রটি কোত্থেকে এসেছে? সেই সূত্র ধরে অভিযান পরিচালনা করা হোক। যাতে করে, এ অঞ্চলের শেষ অবৈধ অস্ত্রটিও উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
ফুটেজে আরও দেখা যায়, গাড়ী ভাংচুরে ব্যবহার করা হয়েছে ধারালো একাধিক চাপাতি। সেগুলোও উদ্ধার করা জরুরি। হামলায় ব্যবহার করা মোটরসাইকেল গুলোও জব্দ করা উচিত।

বিভিন্ন মিডিয়ায় ওঠে এসেছে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগির বিষয় নিয়ে। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের আধিপত্যের বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা জরুরি। যতদূর জানা গেছে, মাদকের একটি শক্তিশালী রেকেট পরিচালিত হয় মাওনায়, যেখান থেকে গোটা গাজীপুরে মাদক ছড়িয়ে পড়ে। এই রেকেট পরিচালনার আধিপত্য বিস্তারই মূলতঃ নেপথ্যের কারণ এই ঘটনার। এই রেকেট পরিচালিত হয়ে আসছে বহুদিন আগে থেকে, সময়ের সাথে শুধু আধিপত্য ও নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। মাদকের রেকেট চলছেই।

অবৈধভাবে অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার সহজ এবং নিরাপদ পরিচয় হিসাবে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করার কৌশল বহু পুরোনো। সেই পুরনো কায়দা ব্যবহার করেই নাছির মোড়লের উত্থান হয়েছে। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাছির মোড়লের পরিবারের সদস্যরাও কম যাননি রাজনৈতিক পরিচয়ে অর্থ বিত্তশালী হওয়ার বিষয়ে। ২০১৯ সালে শ্রীপুর উপজেলার সামনে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জমি দখলের বিরুদ্ধে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন হয়। সেখানে বীরমুক্তিযোদ্ধা সহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। আমি নিজে ‘নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ নামের ব্যানারে সেটি আয়োজন করেছিলাম। সেসময় বিভিন্ন মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছিলো খবরটি। জমি দখলের অভিযোগটি যার বিরুদ্ধে ছিলো, তিনি আর কেউ নন। নাছির মোড়লের পিতা শহিদুল ইসলাম মোড়ল। জমিতে ভুক্তভোগী পরিবার এখনো যেতে পারছেনা, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পিতার বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে এই শহরে! ঘটনা এখানেই শেষ নয়, ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতায় অনেকে নিরব রয়েছে। তবে অনেকে মুখ না খুললেও কেউ কেউ মুখ খুলতে শুরু করেছে!

গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেছেন তার গাড়ীও ভাংচুর করা হয়েছে। তার গাড়ীটি যেখানে রাখা ছিলো, তার আশেপাশে নিশ্চয়ই সিসিটিভি ক্যামেরা সেটআপ রয়েছে। সেখানে নিশ্চয়ই ক্লো পাওয়া যাবে। যদি সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া সম্ভব না হয়, তবে বুঝতে হবে ডালমে ক্যুচ কালা হ্যায়! অর্থাৎ তার নিজের গাড়ী ভাংচুর করার ঘটনা তারই সাজানো নাটক। অনেক ক্ষেত্রে মূল ঘটনাকে আড়াল করতে এসব করা হয়, কৌশলটি অতি পুরনো। ঘটনা যাই হোক, নাসির মোড়লের অভিযোগটিও তদন্ত করা জরুরি।

এবার প্রসঙ্গে আসি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিলেও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। সচেতন মহলের দাবি এমনটাই। কেন সঠিক হয়নি তা হলো, সিহাব, হৃদয় এবং আনোয়ারকে বহিষ্কার করার মাধ্যমে ছাত্রলীগের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। এরা কারা? কার স্বার্থে তারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে? মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিতে যে ঘটনার সূত্রপাত, সেখানে মূল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়া নেতিবাচক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে জনমনে! কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে নেতিবাচক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে এটা নিশ্চিত। অনেকে বলছেন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এই সিদ্ধান্ত নাছির মোড়লকে সাংগঠনিকভাবে রক্ষা করার একটা প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। যদি এমনটা হয়ে থাকে, তবে তা ভয়াবহ বিষয়।

যেনতেন কোনো সংগঠন নয়! নাম যখন ছাত্রলীগ, তখন এই সংগঠনের দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতার জায়গাটিও গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রলীগের মতো একটি স্বনামধন্য এবং ঐতিহ্যবাহী সংগঠনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো কোনো কাজ, এই সংগঠনের কোনো নেতাকর্মীর কাছে কারো কাম্য নয়। কেউ তা মেনে নিতেও প্রস্তুত নয়। তাই, এই সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগ পাওয়া মাত্রই, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। তাদেরকে সংগঠন থেকে তাৎক্ষণিক সাময়িক বরখাস্ত করা উচিত। কারণ, ব্যক্তির অপরাধে, সংগঠনকে কলুষিত করা সম্ভব নয়।

গভীর রাতে একটি শান্ত জনপদে হঠাৎ অস্ত্র মহড়া দিয়ে মুহুর্মুহু গুলি করে একাধিক গাড়ী ভাঙচুর করার যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, তার সাথে ছাত্রলীগের নামটি জড়িয়ে গেছে। তাই, সংগত কারণেই, শ্রীপুরের ঘটনায় অভিযুক্ত সকলকে সাময়িক বরখাস্ত করা উচিত। অপরাধী যদি সাংগঠনিকভাবে যুক্ত থাকে, তবে সেই অপরাধ সংগঠনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এটাই স্বাভাবিক। যা জাতীয় বিতর্কের জন্ম দিতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। যদি এদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়, তবে ছাত্রলীগের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটা আরও মজবুত হতে বাধ্য। যেটা এই সময়ে নতুন কমিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে!

এই সহজ বাস্তবতা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের। আমরা চাই, অপরাধীর পরিচয় হোক শুধু একজন অপরাধী। অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকা উচিত নয়। কতিপয় ব্যক্তির অপরাধকে সাংগঠনিকভাবে বিচার করা না হোক। সকল অপরাধীর বিচার হোক, দেশের প্রচলিত আইনে। দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। আমাদের এই চাওয়া তখনই পূরণ হবে, যখন সংগঠন থেকে অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার বদলে, বহিস্কার করার মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।

শেষ কথা হলো, যেমন মদ উৎপাদন রাষ্ট্রের জন্য লাভজনক হলেও, সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। মদকে প্রকাশ্যে বিক্রির বৈধতা দেওয়াও কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। তেমনি ছাত্রলীগের নাছির মোড়ল সাংগঠনিক ভাবে ‘কেরো মদ।’ আপাতত দৃষ্টিতে লাভজনক তবে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং জনগণের জন্য ভয়ংকর।

লেখক: আনোয়ার হোসেন
আহবায়ক, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।