এম. মতিন, চট্টগ্রাম ॥
শরতের শিশির ভেজা ধরণীতে ক’দিন পরই মর্তলোকে আগমন ঘটবে মা দেবী দুর্গার। তার আরাধনায় মগ্ন হয়ে ভক্তকূল ঘুরে বেড়াবেন মন্ডপে মন্ডপে। ঢাকের তালে কাঁশির বাড়িতে মা দেবী দূর্গাকে আহবান জানানোর প্রহর গুনছে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে এবছর শারদীয় দুর্গা উৎসব পালনে এসেছে পরিবর্তন। তেমন জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন হচ্ছেনা এবারের দুর্গাপূজা। স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দুরত্বসহ ২৬টি নির্দেশনা মেনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পালন করতে হবে এবারের দূর্গা উৎসব। তাই করোনা ভাইরাসকে উপেক্ষা করে জগৎজননী মাকে বরণ করে নিতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ১৫৫টি পূজা মন্ডপে চলছে শারদীয় দুর্গাপূজা পালনের জোর প্রস্তুতি।
শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপন উপলক্ষে উপজেলার ১৫৫ টি মন্ডপে ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে প্রতিমা তৈরির কাজ। প্রতিমার গায়ে রং তুলির শেষ আঁচড় লাগাতে এখন ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা। সমানতালে চলছে মন্দিরের সাজসজ্জার কাজও। দুই-তিনদিনের মধ্যে রং ও সাজসজ্জার কাজ শেষ হলে মন্দিরে মন্দিরে উচ্চারিত হবে উলুধ্বনি ও চণ্ডীপাঠ। আগামি ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী, দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। আর (২৬ অক্টোবর) বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হবে এ উৎসব।
সারাদেশের মতো এবছর রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ২টি ঘট পূজাসহ ১৫৫টি মন্ডপে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্জের মধ্যদিয়ে উদযাপিত হবে শারদীয় দুর্গোৎসব। শান্তিপূর্ণভাবে পূজা সম্পন্ন করতে মন্ডপগুলোতে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে উপজেলা প্রশাসন।
সরেজমিনে উপজেলার স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়ার ক্ষেত্রপাল মন্দির, নাথপাড়া মন্দির, রাসমন্দির, রামকৃষ্ণ মঠ, হোচনাবাদ ইউনিয়নের সাহাপাড়া সার্বজনীন শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির, লালানগর ইউনিয়নের শ্রীশ্রী কালীমন্দির, দাসপাড়া রামকৃষ্ণ মন্দিরসহ বিভিন্ন পূজামন্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিমা তৈরির কাজ অনেকটাই শেষ। এখন চলছে প্রতিমার গায়ে রং তুলির শেষ আঁচড়। একাজে স্থানীয় শিল্পী ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিমা তৈরি করতে আসা মৃৎশিল্পীরাও রং তুলির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তুলির আঁচড়ের সাথে পোশাক -অলংকার পরিয়ে দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হচ্ছে দুর্গা, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী, লক্ষ্মী ও মহিষাসুরের প্রতিমা।
এদিকে পূজামণ্ডপকে পূর্ণাঙ্গ শৈল্পিক রূপ দিয়ে ভক্ত-দর্শনার্থীদের কাছে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে কারুশিল্পীদের ব্যস্ততার শেষ নেই। তাদের পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র ঠিক ও তৈরী করতে ব্যস্ত ঢাক-ঢোল, কাঁশি ও বাঁশির কারিগররা। সেসাথে ব্যস্ত সময় পার করছেন পূজামণ্ডপকে ঘিরে মঞ্চ, প্যান্ডেল, তোরণ নির্মাণ ও আলোকসজ্জার কাজে নিয়োজিত ডেকোরেটর এবং হিন্দুধর্মালম্বীর লোকজন।
অন্যদিকে এসব প্রস্তুতি শেষ হলেই ঢাকের বাজনা, শঙ্খধ্বনি আর আরতিতে মুখরিত হয়ে উঠবে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রাম, পাড়া ও মহল্লার গড়ে উঠা মন্দির-মণ্ডপগুলো।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বিভূতি ভূষণ সেন বলেন, ‘আগামি ২২ অক্টোবর ষষ্ঠী তিথিতে শুরু হয়ে ২৬ অক্টোবর দশমী তিথিতে প্রতিমা বির্সজনের মধ্যে দিয়ে দুর্গাপূজা শেষ হবে। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এ বছর সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজা করতে হবে। এ সর্ম্পকিত ২৬টি নির্দেশনা রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকেই এ নিদের্শনা মেনে পূজা করতে হবে
তিনি আরও বলেন, ‘এবার পূজোয় অবশ্যই ভক্তদের মুখে মাস্ক পরতে হবে। সরকারি নিয়ম মেনে সামজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিমা দর্শন করতে হবে।’
উপজেলা পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ দাশ বলেন, ‘জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার (দোলায়) চড়ে কৈলাশ থেকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসবেন। এতে জগতে মড়কব্যাধি ঘটনা বাড়লেও আশার আলো হচ্ছে মা দেবী দূর্গা এবার দশমীতে জল বিসর্জনায় শিবের সঙ্গে স্বামীর গৃহে কৈলাশে (স্বর্গে) ফিরে যাবেন (গজে) চড়ে। গজে গমণের ফলে বসুন্ধরা হয়ে উঠবে শস্যপূর্ণ। অর্থাৎ মায়ের গজে গমনের ফলে এবার মানুষ অন্তত ভালোভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারবে।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) মোঃ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের ২৬ দফা নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা পালনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পূজা মন্ডপগুলোতে সাউন্ড সিস্টেম ও সীমিত পর্যায়ে আলোকসজ্জা, জনসমাগম সীমিত রাখা এবং মাদক মুক্ত পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে সার্বক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক সহযোগীতা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়াও কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা আসবে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
রাঙ্গুনিয়া থানা ইনচার্জ (ওসি) মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আসন্ন দুর্গাপূজায় শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে প্রতিটি মন্ডপে পুলিশ ও আনসার-ভিডিপি সদস্যরা নিয়োজিত থাকবে। এছাড়া আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ভ্রাম্যমাণভাবে টহলও দিবে।’
এদিকে করোনার প্রবল দাপটের মধ্যেও এবার দেবী দুর্গা ‘দোলা’য় আগমন করায় মড়ক, অস্থিরতা প্রভৃতি লেগে থাকার হতাশা হলেও, ‘গজে’ গমনের ফলে পূর্ণ থাকবে দেশের শস্য ও জল ভাণ্ডার। কিছুটা কাটবে আর্থিক সঙ্কটও। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবস্থারও কিছুটা উন্নতি ঘটবে। মায়ের আর্শীবাদে দূর হবে সকল অন্ধকার, বিশৃঙ্খলা আর ধরাধামে শান্তির সুবাতাস বইবে- ভক্তদের এমনটাই প্রত্যাশা।