শনিবার , ২১শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ , ৬ই আশ্বিন, ১৪৩১ , ১৭ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৬

হোম > Uncategorized > হারিয়ে যাচ্ছে মায়ের নাড়ির টান

হারিয়ে যাচ্ছে মায়ের নাড়ির টান

শেয়ার করুন

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ জিনের অনেক রহস্য এখনও অজানা। জিনের সেরকমই বিরল এক বৈশিষ্ট্যে, কখনও সন্তানের শরীরে মিলছে না মায়ের চিহ্ন। দশমাস দশদিন গর্ভধারণ করে সন্তানের জন্ম দিলেন। পরে রক্ত পরীক্ষায় প্রমাণ মিলল তিনি নাকি সেই সন্তানের মা (বায়োলজিক্যাল মাদার) নন! সন্তানের সঙ্গে আপনার জিনোমের মিল না থাকায় এই বিপত্তি। শুনে গল্পকথা মনে হলেও বাস্তবে এ ধরনের বিভ্রাটের শিকার হতে পারি আমি আপনি যে কেউই। তাই ডিএনএ পরীক্ষা করে পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্বের দাবি খারিজ বা বহাল করার আগে দুইবার ভাবার সময় কিন্তু এসে গিয়েছে। ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রেও তাই রয়ে যাচ্ছে প্রমাণের ফোকর গলে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ।

খুব বেশি দিন নয়, এই বছর চারেক আগেকার কথা। ভারতের এক আদালতের কাঠগড়ায় ছিলেন প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবসায়ী। অভিযোগকারিণী মহিলা কল্পনাদেবী (নাম পরিবর্তিত) দাবি করেছিলেন, ১৩ বছর সুখী সাংসারিক জীবন কাটানোর পর পরনারীতে আসক্ত হয়ে তাঁকে ও তাঁর দুই সন্তানকে স্ত্রী-পুত্রের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে অস্বীকার করছেন তাঁর স্বামী। তাঁর না হয় বিয়ের কাগজপত্র নেই। তা বলে তাঁদের দুই সন্তান তো রয়েছে। আদালত যেন তাঁদের প্রাপ্য সুবিচার দেয়। আদালত মা, বাবা ও সন্তানদের ডিএনএ পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। আর পরীক্ষার পর যে রায় এসেছিল তা চোখ কপালে তুলে দেওয়ার মতো। দেখা গিয়েছিল, ওই দুই সন্তানের রক্তের সঙ্গে তাদের মায়ের ডিএনএ গঠনের মিলই নেই, সোজা কথায় তিনি ওদের জন্মদাত্রী মা নন। আদালতে রিপোর্ট পেশ হওয়ার চার দিনের মাথায় আত্মহত্যা করে সব জ্বালা জুড়িয়ে ছিলেন ওই মা। পরে পুলিশের তদন্তে জেরার মুখে সব স্বীকার করে নিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী।

কেনও এমন হল? ডিএনএ পরীক্ষাও কি তবে ভুল রিপোর্ট দিয়েছিল? নাকি অন্য কোনও অন্য কোনও রহস্য! পরীক্ষার ভুল নয়। এটি হল ‘কাইমেরিজম’ নামে মানব-জিনোমের (সব জিনের সমষ্টি) এক বিরলতম বৈশিষ্ট্য যার দরুণ প্রাথমিক ভাবে ধরা পড়েনি মা ছেলের নাড়ির টান। কাইমেরার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেও বিশদ গবেষণা এখনও শৈশব স্তরেই রয়েছে বলে জানিয়েছেন আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জেনেটিক্স বিভাগের গবেষক ডক্টর আলেকজান্ডার আরবান। কাইমেরা পাঠ্য বইয়ে থাকলেও যে ভাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে এর রোগীর সন্ধান মিলছে, তাতে একে নিয়ে অবিলম্বে বিস্তারিত গবেষণা ও জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডক্টর আরবান। সম্প্রতি সায়েন্স পত্রিকায় এ সংক্রান্ত তাঁর একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে।

গত শতকের শেষ দিকেও বিজ্ঞানী, চিকিত্সকদের সাধারণ ধারণা ছিল, প্রাণী দেহের যে কোনও একটি কোষ থেকে পাওয়া জিনোমেই লুকিয়ে থাকে তার বংশগতির ঠিকুজি-কুষ্ঠি। তার জন্য বাকি কোষে ছানবিন করার কোনও দরকারই নেই। আর সেটা যে সঠিক নয়, কাইমেরিজমই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কলকাতায় জিন চরিত্র বিশ্লেষণের অন্যতম কেন্দ্র বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের (ভিআইএমএস) জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপিকা ডক্টর অজন্তা হালদার জানালেন, এই মুহূর্তে শহরে ডিএনএ পরীক্ষার খুব বেশি সুবিধা নেই। শুধু কাইমেরাই নয়, টার্নার সিন্ড্রোম, মোসেইকসিজ্ম-এর মতো একাধিক বিরল জিনঘটিত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে তাঁদের কাছে। লিউকোসাইট কালচার করে যাঁদের ক্রোমোজোমের কেরিওটাইপিং করতে গিয়ে বেরিয়ে আসছে জিনের জাদুকরী গঠনের অচেনা সব ছবি।

তাঁর কাছেই জানা গেল, কাইমেরা সৃষ্টির ইতিবৃত্তের কথা। মাতৃগর্ভে সাধারণত একটি ডিম্বাণুই (ঢ ক্রোমোজোম) নিষিক্ত হয় পিতার শুক্রাণু (ণ ক্রোমোজোম) দ্বারা৷ তৈরি হয় জাইগোট (ত১)। তবে কোনও ভাবে মায়ের গর্ভে থেকে যাওয়া দ্বিতীয় একটি ডিম্বাণুও একই ভাবে নিষিক্ত হয়ে দ্বিতীয় একটি জাইগোট (ত২) গঠন করতে পারে কোনও সময়। সে ক্ষেত্রে দু’টি সম্ভাবনা থাকে৷ প্রথমত, দুইটি সন্তানেরই জন্ম হওয়া (নন-আইডেন্টিক্যাল টুইন)। দ্বিতীয়ত, দুইটি জাইগোট জুড়ে গিয়ে একটিই সন্তানের জন্ম হওয়া। ধরা যাক সেই সন্তান মেয়ে (উ) হল। সে ক্ষেত্রে তার সঙ্গে স্বাভাবিক পুরুষের (ক্রোমোজোম ঢণ) মিলনে জন্মানো সন্তানের সঙ্গে মায়ের মিল অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যাবে না।

মায়ের (উ) শরীরের যে যে অঙ্গ ত১ জাইগোটের অংশ থেকে সৃষ্ট হবে, তার সঙ্গে ত২ জাইগোটের থেকে সৃষ্ট অঙ্গের জিনোমের কোনও মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বোঝার সুবিধার্থে ধরে নেওয়া যাক, মায়ের (উ) রক্ত তৈরি হয়েছে ত২ জাইগোটের থেকে আর স্ত্রী-জননতন্ত্র গঠিত হয়েছে ত১ জাইগোটের থেকে। সে ক্ষেত্রে সন্তানের রক্তের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে কোনও দিন প্রমাণ করা যাবে না যে সে তার মায়েরই গর্ভজাত সন্তান। মা সারোগেট মাদার নন বা তাকে কোথাও থেকে দত্তক নেননি বা চুরি করে আনেননি৷ দু’টি জাইগোট জুড়ে গিয়ে হওয়া ওই মা হল হিউম্যান কাইমেরা।