* মূলহোতারা বিদেশে অবস্থান করেই পাচার, জিম্মি, মুক্তিপণ নিয়ন্ত্রণ করে
* দশ মাসে পাচারকালে ৭২৬ জনকে উদ্ধার করেছে বিজিবি
* মানবপাচারে জড়িত আছে দেশের চার শতাধিক চক্র
* মামলা হলেও তালগোল পাকিয়ে ফেলেন তদন্তকারীরা
বিশেষ প্রতিবেদক
সরকারি নানা উদ্যোগ, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দৌড়ঝাঁপ- কোনো কিছুতে মানবপাচার থামছেই না। বরং হঠাৎ করেই অজ্ঞাত কারণে মানবপাচার আশংকাজনক ভাবে বেড়ে গেছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে-বিদেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানবপাচারকারী চক্রগুলো। মূলহোতাদের একটি বড় অংশই বিদেশে অবস্থান করে পাচার, জিম্মি ও মুক্তিপণ আদায় করছে। এর প্রমাণও মিলেছে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান, তৎপরতা এবং পাচারকালে উদ্ধার হওয়া মানুষের নানা বক্তব্যে।
বিগত ১০ মাসের এক পরিসংখ্যান সূত্রে উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। ওই সময় সীমান্ত অতিক্রম ও পাচারের সময় ৭২৬ জনকে উদ্ধার ও আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এর মধ্যে গত বছরের শুধু অক্টোবর মাসেই উদ্ধার ও আটকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৫ জনে। এর আগে লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশিকে মানবপাচারকারী চক্র হত্যার পর মানবপাচারের ২৫টি মামলায় এখন পর্যন্ত ১৭১ আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মানবপাচারে দেশে ছোট বড় প্রায় ৪০০ চক্র সক্রিয় ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর মনোভাব ও ধারাবাহিক অভিযানে চলতি বছর গ্রেপ্তার হয়েছে অর্ধশতাধিক চক্র। আকাশপথে মানবপাচারে দুইটি এয়ারলাইন্সের সম্পৃক্ত পেয়েছে সিআইডি। কর্মকর্তারা বলছেন, মানবপাচারে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশও রয়েছে। ধাপে ধাপে মানবপাচার হওয়ায় দালালসহ দুই-তিন ধাপের পাচারকারীর ব্যাপারে তথ্য পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূলহোতারা আইনের আওতায় আসে না। পাচারকারী মূলহোতাদের একটি বড় অংশ পরিবার নিয়ে বিদেশেই অবস্থান করেন। অকাট্য তথ্য-প্রমাণাদির অভাবে রাঘববোয়ালদের চার্জশিটভুক্ত আসামি করা যায় না বলে জানিয়েছেন মানবপাচার সংক্রান্ত মামলার তদন্তকারী একাধিক কর্মকর্তা।
মানবপাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোতাদের একটি বড় অংশই মধ্যপাচ্যে অবস্থান করছে। ইউরোপেও রয়েছে কয়েকজন। এছাড়া সম্প্রতি মানবপাচারের ঘটনায় ইন্টারপোলের রেডঅ্যালার্ট জারি হওয়া ছয়জন ইতালি ও মধ্যপাচ্যে অবস্থান করছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য নারী-পুরুষকে বিভিন্ন দেশে পাচারের সঙ্গে দুটি বিদেশি এয়ারলাইন্সের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। দুই এয়ারলাইন্সের সাতজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি কর্মকর্তারা। পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হোতাদের মধ্যে কয়েকজন ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে ছয়জনকে ধরতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশও জারি করা হয়েছে। অবৈধ পাচার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে মানবপাচারকারী চক্রের বিশাল জাল রয়েছে। এরা বাংলাদেশি নাগরিক ছাড়াও কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে অবৈধ কার্যক্রম চালায়। পাচারে জড়িত বাহকরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালদের এখনও ধরা যাচ্ছে না। মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
পাচারের পর দেশে ফিরে আসা একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, মূলত উন্নত জীবনের হাতছানিতে তারা ঝুঁকি নিয়ে দেশের বাইরে যান। পেটের দায়ে কাজ করে খেতে তারা বিদেশে গিয়েছিলেন। বিদেশে গেলে নিজে ভালোভাবে খেতে পারবে। পরিবারকেও ভরণপোষণ করাতে পারবে বলে তাদের প্রলোভন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অবৈধ পন্থায় বিদেশে গিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। এখন চাইলে দেশেও ফিরতে পারছেন না। আবার দেশে ধারদেনা করে উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে এসেছিলেন, সেই ধারদেনাও পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে দেশে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনও হয়রানির শিকার হচ্ছে।
দশ মাসের এক পরিসংখ্যান দিয়ে বিজিবি সূত্র জানায়, অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে আটক এবং পাচারকালে উদ্ধার হওয়া মানুষের সংখ্যা ৭২৬ জন। এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা ২৪৬ জন। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে পাচার ও সীমান্ত অতিক্রমকালে আটকের সংখ্যা ছিল ৩০ জন। বছরের সবচেয়ে কম এপ্রিল মাসে মাত্র চারজনকে উদ্ধার ও আটক করা হয়। এরপর উদ্ধার ও আটকের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে সেপ্টেম্বর মাসে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১১০ জনে। সর্বশেষ অক্টোর মাসে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৫ জনে। এর মধ্যে ১৮০ জন পুরুষ, ৭৪ জন নারী ও একজন শিশু রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, মানবপাচারের এ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মানবপাচারে জড়িত রাঘববোয়ালদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাই বাহক বা চুনোপুঁটি ধরা পড়লেও হোতারা ধরা পড়ছে না। মানবপাচারে আমাদের যে অবস্থান সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশের ভাবমূর্তি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। যে-সব দেশে আমরা অনঅ্যারাইভাল ভিসা পাই সেটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চাকরি দেওয়ার নামে দেশি-বিদেশি চক্র প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করছে। মানব পাচারকারীরা অনেকের আর্থসামাজিক অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশে ভালো চাকরির টোপ দিয়ে পাচার করা নারীদের যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে। পাচারের শিকার প্রায় ৪০ শতাংশ নারী এবং ১৫ শতাংশ শিশু। পাচারের সঙ্গে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালীদের পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সির নামও এসেছে। তারা বেশি টাকার বিনিময়ে অবৈধ উপায়ে বিদেশে কাজের নামে পাচার করে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, মানবপাচারে জড়িত রাঘববোয়ালরা অধিকাংশই পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বাইরে থাকে। তাই হোতাদের ধরা যায় না। দেশে দালালদের মাধ্যমে এ কারবার চালিয়ে যায় তারা। হোতারা অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ায় অকাট্য প্রমাণের অভাবে তাদের আইনের আওতায়ও আনা যায় না। তবে মানবপাচারকারীদের সম্প্রতি তালিকা করা হয়েছে। তালিকা ধরে অপরাধীদের গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, পাচারকারীরা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্নজনকে বিশ্বের নানা দেশের নৌপথ, গহিন জঙ্গল ও মরুপথে নিয়ে যায়। দেশ থেকেই তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেওয়া হয়। এরপর বিদেশের মাটিতে জিম্মি করে তাদের কাছ থেকে আরও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। বিদেশে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের নির্যাতন এমনকি হত্যা পর্যন্ত করে পাচারকারীরা