আন্তর্জাতিক ডেস্ক ॥
জামাল খাসোগির কখনই ভিন্নমতাবলম্বী হওয়ার অভিপ্রায় ছিল না। বহু বছর ধরে তিনি সৌদি আরবে সংবাদপত্র সম্পাদনা এবং লেখালেখি করেছেন। ওয়াশিংটন ও লন্ডনে সৌদি দূতাবাসের একজন সহযোগী হিসেবেও কাজ করেছেন।
যা তাকে দেশটি ছাড়তে ও ওয়াশিংটন পোস্টের জন্য নিবন্ধ লিখতে উৎসাহিত করেছে, তা হচ্ছে- সিংহাসনের উত্তরসূরি মোহাম্মদ বিন সালমানের শাসনে অভ্যন্তরীণ নিপীড়ন আকস্মিক বেড়ে যাওয়া।
প্রতিবাদ করতে যাওয়া ধর্মীয় নেতা এবং বুদ্ধিজীবীদের আতঙ্ক, ভীতিপ্রদর্শন, গ্রেফতার ও প্রকাশ্যে অপমান করা হচ্ছে বলে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রথম নিবন্ধে তিনি লিখেছেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে সেটি প্রকাশ করা হয়েছিল।
পরের বছর ওয়াশিংটনের পোস্টে নিজের লেখনীতে ও ইন্টারনেটে ৫৮ বছর বয়সী এই সাংবাদিক তখনকার ৩২ বছর বয়সী সৌদি শাসকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।
মোহাম্মদ বিন সালমানের শীর্ষ সহযোগীর নিয়ন্ত্রিত ট্রল দল ইন্টারনেটে তাকে কঠোর সমালোচনায় জর্জরিত করেন।
কেবল সমালোকদের নিপীড়নের দায়ে যুবরাজকে চ্যালেঞ্জ জানাননি খাসোগি। এই নিপীড়ন দেশকে আধুনিকায়ন ও নতুন প্রাণশক্তি দেয়ার উচ্চাভিলাষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেও ব্যাখ্যা দেন তিনি।
মোহাম্মদ বিন সালমানের বেপরোয়া আঞ্চলিক এজেন্ডার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়েছেন এই সাংবাদিক। বিশেষ করে ইয়েমেন যুদ্ধ। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময় এই অভিযান শুরু করেন যুবরাজ।
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা দমন ও ইসলামপন্থী দলগুলোকে রাজনীতি থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টার নিন্দা জানিয়েছেন খাসোগি। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্যাপকভাবে এই উদ্যোগ চালিয়ে আসছে।
এই বিতর্ক অব্যাহত রাখতে খাসোগির সক্ষমতাকে ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর শেষ করে দেয়া হয়েছে। সেদিন আমাদের কলামনিস্ট হেঁটে ইস্তানবুলে সৌদি কানস্যুলেটে ঢোকেন, সেখানে দ্রুতই তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
রিয়াদ থেকে খাসোগিকে হত্যায় পাঠানো ১৫ জনের একটি দল এ নৃশংসতা চালিয়েছেন। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যানুসারে মোহাম্মদ বিন সালমান অনেকটা নিশ্চিতভাবেই এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন।
জাতিসংঘের একটি তদন্তেও তাকে দায়ী করা হয়েছে।
একদিক থেকে তিনি সফল হয়েছেন: খাসোগির তীক্ষ্ণ ও মর্মভেদী কলাম ওয়াশিংটন পোস্টে আর প্রকাশিত হচ্ছে না। সৌদি যুবরাজ ও হত্যা অভিযানের তদারকি করা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৌদ আল-কাহতানি বিচার থেকে রেহাই পেয়েছেন।
এই তরুণ একনায়ককে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বরণ করে নেয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্রুতই অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন। সৌদি আরবকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে কংগ্রেসের চেষ্টাকেও আটক দিয়েছেন ট্রাম্প ও তার মিত্ররা।
চলতি সপ্তাহে সম্প্রচারিত দুটি সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ বিন সালমান কপটতার সঙ্গে বলেন, হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন, তবে এতে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
আসলে যারা তাকে মাফ করে দিতে ইচ্ছুক, কেবল তারাই এ মিথ্যাকে মেনে নেবেন।
খাসোগি ও মোহাম্মদ বিন সালমানের কাহিনী এখনও শেষ হয়ে যায়নি। যেসব হুশিয়ারি এই সাংবাদিক আগেই ব্যক্ত করেছিলেন, সেগুলোই এখন সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। কখনও কখনও তা ছিল যুবরাজকে বন্ধুসুলভ পরামর্শ।
বছরখানেক পরে, বিরোধীদের ওপর নিপীড়নের পরিণতি অব্যাহতভাবে ভোগ করছে সৌদি রাজ্য। বিশেষ করে নারীদের আরও বেশি অধিকার দাবি ও দুষ্টবুদ্ধিপ্রসূত ইয়েমেন হস্তক্ষেপ।
সতর্ক করে দিয়ে খাসোগি বলেছিলেন, অ্যাকটিভিস্টদের ওপর নিপীড়নের পাল্টা প্রতিক্রিয়া আসবে এবং সেটি এসেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি আরবের নিন্দা জানিয়েছে। আর পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে অস্পৃশ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
খাসোগি জোর দিয়ে বলেছিলেন, ইয়েমেন যুদ্ধ কেবল অজেয়ই নয়, সৌদি আরবকে কম সুরক্ষিত করে দেবে। এতে নিজ ভূখণ্ডে হতাহত ও ক্ষতির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে। গেল বছরের সেপ্টেম্বরে একটি কলামে তিনি এ কথা লিখেছেন।
ওই লেখায় তিনি আভাস দেন, গুরুতর লক্ষ্যবস্তুগুলোর সুরক্ষায় মার্কিন নির্মিত প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারবে না।
বছরখানেক পরে যখন সম্ভবত ইরান থেকে উৎক্ষেপণ করা ড্রোন ও ক্রুজ মিসাইল সৌদি স্থাপনায় হামলা চালায়, তখন তার সেই কথা বেদনাদায়ক হলেও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
যদিও হামলার দায় স্বীকার করেছে প্রতিবেশী ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা।
কোটি কোটি ডলারের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সৌদির সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদন স্থাপনায় বিপর্যয় ঘটিয়েছে।
ওই হামলার প্রত্যাশিত পরিণতি মোহাম্মদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর শেয়ারের আন্তর্জাতিক বিক্রি আরও বিলম্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ভবিষ্যতে যেকোনো হামলা থেকে সৌদি আরবকে রক্ষায় ওয়াশিংটনের সমর্থন নাজুক অবস্থায় রয়েছে। খাসোগির কথা উল্লেখ করে হাউস স্পিকার ন্যানসি পেলোসি যখন বলেন, সৌদির সমর্থনে মার্কিন সামরিক পদক্ষেপে তিনি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করছেন না।
পেলোসি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে, যিনি একজন প্রতিবেদককে কেটে টুকরো টুকরো করেছেন এবং রাসায়নিক দিয়ে তার শরীর গলিয়ে ফেলেছেন। সৌদি আরবের সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষায় আমাদের কোনো দায়িত্ব আছে বলে মনে করছি না।
মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার গলা টিপে ধরার অভিযানে সমর্থন হারাচ্ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান।
ব্যাপক গণআন্দোলন ঠেকানোর আশায় সুদানের সামরিক শাসককে টিকিয়ে রাখতে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে সৌদি ও আমিরাত।
তারা কেবল এতটুকু দেখতে চেয়েছেন যে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগে তিন বছরের একটি অন্তবর্তীকালীন শাসনের চুক্তি করেছেন জেনারেলরা।
আলজেরিয়ায়ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্থান দেখা গেছে। ভিন্নমতাবলম্বী এক ব্যবসায়ীর আহ্বানে সম্প্রতি মিসরেও বিক্ষোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অথচ এ রাষ্ট্রটির সামরিক সরকারকে সৌদি কোটি কোটি ডলারের ভর্তুকি দিয়ে আসছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের নীতি তাকে একটি ছোট্ট কানাগলির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি সম্ভবত তার আকস্মিক বড় পতনও ঘটতে পারে।
বিভিন্ন কেলেঙ্কারির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্র্নিবাচনের প্রচারেই তার এখন অখণ্ড মনোযোগ। কাজেই মোহাম্মদ বিন সালমাকে খুব বেশি সহায়তার সুযোগ তার হাতে নেই।
যুবরাজ এখনও নিজেকে পতন থেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু তাও তখনই সম্ভব, যখন তিনি খাসোগির দেয়া পরামর্শে চূড়ান্তভাবে মনোযোগী হবেন।
তা হচ্ছে- নারী অধিকারকর্মী ও অন্যান্য রাজনৈতিক কারাবন্দিদের ছেড়ে দিয়ে যারা তাদের নির্যাতন করেছেন, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। আর ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে সরে আসতে হবে।
এ ছাড়া খাসোগির মতো শান্তিপূর্ণ সমালোচকদের দেশে ফিরতে দিয়ে তাদের মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সর্বশেষ কথা হচ্ছে, অর্ধসত্য বলে না বেড়িয়ে খাসোগি হত্যার পূর্ণ দায় তাকে নিতে হবে।
এসব কিছু শিগগিরই ঘটবে বলে প্রত্যাশা করছি না। কিন্তু আমরা মনে করি, একদিন ইতিহাসই বলে দেবে, আমাদের হারানো বন্ধু ও সহকর্মী জামাল খাসোগি সেই বিতর্কের সঠিক দিকটিতেই ছিলেন যে মোহাম্মদ বিন সালমান ভেবেছেন, তিনি রক্তাক্ত উপায়ে বিজয়ী হতে পারবেন।