ভুয়া আবেদন : পছন্দের কলেজে ভর্তির অনিশ্চয়তায় শিক্ষার্থীরা

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥

এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেছে। এবার কলেজে ভর্তি হবার পালা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কলেজে ভর্তি আবেদন করতে গিয়ে দেখেন তার আবেদন অন্য কেউ করে ফেলেছে। এটি দেখেই মাথায় হাত তাদের। অনেকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের পচ্ছন্দের কলেজে ভর্তি হওয়ার নিশ্চয়তা পেতে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে এসেছেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে।

রোববার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ভিড় জমিয়েছেন। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি আবদেন করতে না পেরে বোর্ডে এসে আর্তনাদ করছেন তারা। কলেজে ভর্তি হতে পারবে কি পারবে না তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

ছাত্র না পাওয়ার আশঙ্কায় ভুঁইফোড় কিছু কলেজ শিক্ষার্থীদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নিজেরাই অনলাইনে ভর্তির আবেদন করছেন। পরে ওই সব শিক্ষার্থীরা নিজের পছন্দের কলেজে ভর্তির আবেদন করতে গিয়ে আবেদন সম্পন্ন হয়েছে দেখে ভেঙে পড়েন। বাধ্য হয়ে তারা শিক্ষা বোর্ডে এসে অভিযোগ করছেন।

ভুয়া আবেদনের চাপে বিপাকে পড়েছে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এজন্য বোর্ড একটি আলাদা সেল গঠন করে ভুক্তভোগীদের আবেদন জমা নিতে দেখা গেছে। এছাড়া একাদশে ভর্তি আবেদন প্রক্রিয়ায় নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ভর্তিচ্ছুরা। সার্ভার সমস্যা, ফিরতি এসএমএস না পাওয়াসহ নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।

ফরিদপুর সদর থেকে এসেছেন মো. মালাম উদ্দিন। কে বা কারা তার মেয়ের আবেদন সম্পন্ন করে ফেলেছেন যা তারা জানেন না। মেয়েকে একটি ভালো কলেজে ভর্তি করাবেন এই স্বপ্ন তার। অথচ তাদের অজান্তেই কেউ এ আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি জানার পর তার মেয়ে সুরাইয়া মিম ও তার মা আমেনা মিম নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বাধ্য হয়ে তিনি ঢাকা বোর্ডে এসেছেন এ সমস্যা সমাধানের আশায়।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার মেয়ে কলেজ ভর্তি আবেদন করতে গিয়ে দেখে তার আবেদন অন্য কেউ করেছে। এটি দেখে সে ঘাবড়ে যায়। বিষয়টি জানার পরে পরিবারে এক ধরণের শোক নেমে আসে। তাই রোজা রেখে বাধ্য হয়ে ভোর ৬টায় বোর্ডে এসেছি। বোর্ডের কর্মকর্তা বলেছেন- অভিযোগ লিখে জমা দিতে। লিখিত অভিযোগ জামা দিয়েছি। আগের আবেদন বাতলি করে দেয়া হবে বলা হয়েছে। তবে কবে তালিক করা হবে তা জানানো হচ্ছে না।

গাজীপুরের বাসিন্দা নূর ইসলাম। ভ্যান চালিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করান। তার ছেলে ফারুক আহমেদ এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৩.৫ পেয়েছেন। একটি ভালো কলেজে ভর্তি করানোর ইচ্ছে এই বাবার। অথচ একাদশ শ্রেণির ভর্তি আবেদন করতে গিয়ে দেখেন আগেই তার আবেদন করা হয়েছে। এটি দেখে বাবা-ছেলে হতাশ হয়ে পড়েন। ছেলের সমস্যা নিয়ে সকাল সকাল গাজীপুর থেকে ঢাকা বোর্ডের এসেছেন। তৃতীয় তলায় কলেজ শাখায় ছেলেকে নিয়ে আর্তনাদ করছেন।

তার সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্টে ছেলের পড়ালেখার খরচ চালাই। ছেলেডারে একটা ভালো কলেজে ভর্তি করামু এই স্বপ্ন আমার। কিন্তু এলাকার কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে ভর্তি আবেদন করতে গিয়া দেখি ওর (ছেলের) আবেদন হইয়া গেছে। এটা দেইখা অনেক কষ্ট পাইছি। বুকটা ফাইটা কান্না চইলা আইছে। কেন আমার পোলার লগে এমন কাজ করলো।’ এই বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

ছেলে-মেয়ের পছন্দের কলেজ ভর্তি আবেদন করতে না পেরে নারায়ণগঞ্জ থেকে বোর্ডে এসেছেন ইউসুফ মিয়া। অনলাইনে তার ছেলে ও মেয়ের আবেদন সম্পন্ন করলেও তারা সিকিউরিটি ম্যাসেজ পাননি। এটি না পেয়ে তারা ঘাবড়ে গেছেন। নারায়নগঞ্জ থেকে সন্তানদের নিয়ে ঢাকা বোর্ডে এসে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন।

ইউসুফ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘গরিব মানুষ আমরা। পোলা-মাইয়াডারে লেহাপড়া শিখাইয়া বড় মানুষ করার ইচ্ছা আমগো। এসএসসি পরীক্ষা ওরা (ছেলে-মেয়ে) ভালো রেজাল্ট করছে। এহন কলেজে ভর্তি করামু কিন্তু হেইডা পারতাছি না। নানান সমাস্যা দেখা দিছে। বোর্ডে আইছি। একজন স্যার কইলো অভিযোগ লেইখা দিতে। অভিযোগ দিছি, ঠিক হইয়া যাইবো কইছে স্যারেরা।’

জানা গেছে, অনলাইন বা মোবাইল ম্যাসেজের মধ্যেমে কলেজ ভর্তি আবেদন করতে গিয়ে প্রতিদিন নানা সমস্যায় নিয়ে দেশের দূর-দূরন্ত থেকে ছুটে আসছে। কারো রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিয়ে অন্য কেউ আবেদন করেছে, কেউ সিকিউরিটি কোড নম্বর পাচ্ছে না, কারো আবেদন আবেদন অসম্পূর্ণ হয়ে আছে সম্পূর্ণ হচ্ছে না, এমন নানা সমস্যা নিয়ে ছুটে আসছেন।

ঢাকা বোর্ডের সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক ভুয়া আবেদনের অভিযোগ জমা পড়েছে বোর্ডে। বিভিন্ন ভুঁইফোড় কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থী না পাওয়ার আশঙ্কায় প্রার্থীর অজান্তে কলেজ ভর্তির আবেদন সম্পন্ন করেছে। আবেদন প্রক্রিয়া শুরু পরদিন থেকেই এমন অভিযোগ আসছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে। প্রতিদিন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা এসে ভুক্তভুগীরা ঢাকা বোর্ডের কলেজ শাখায় ধর্ণা দিচ্ছেন। তারা বিভিন্ন সমস্যার বিষয় উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের আবেদনের ভারে অস্তির সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুয়া আবেদন করার পেছনে বেশ কিছু ভুঁইফোড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের না জানিয়ে তাদের নিজ কলেজে নির্বাচন দিয়ে আবেদন করছেন। এসব কলেজে সাধারণত শিক্ষার্থী ভর্তি হতে আগ্রহী না হওয়ায় বিভিন্ন স্কুল থেকে সদ্য পাশ করা শিক্ষার্থীদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে ভর্তি আবেদন করছে।

এছাড়াও অনেক স্কুলে সম্প্রতি কলেজ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সেসব কলেজে শিক্ষার্থী না পাওয়ার আশঙ্কায় তাদের স্কুল থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীদের তথ্য দিয়ে সেই কলেজে আবেদন করা হচ্ছে।

বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন আমরা ভুয়া আবেদনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আবেদনের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমরা বোর্ডের দুটি রুমে এ সংক্রান্ত একটি সেল তৈরি করেছি। সেখানে অভিযোগকারীদের নম্বপত্রের মূল কপি থেকে লিখিত আবেদন নেয়া হচ্ছে। এরপর আমরা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পূর্বৈর ভর্তি আবেদন বাতিল করে নতুনভাবে আবেদন করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভর্তিইচ্ছুদের না জানিয়ে আবেদন করা হলে তা জালিয়াতি বলে গণ্য হবে। সে বিষয়ে ভর্তি নীতিমালায় শাস্তি বিষয়টি উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। এমন জালিয়াতির জন্য প্রতিষ্ঠানের এমপিও বাতিল অথবা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন স্বীকৃতি বাতিল করা হবে। ভর্তি কার্যক্রম শেষ হওয়ায় পর সেসব কলেজের কলেজ কোড দ্বারা সে প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তথ্যমতে, দেশের আটটি সাধারণ ও মাদরাসা বোর্ডের অধীনে ৭ হাজার ৩১৯টি কলেজে ২৮ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৯টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বোর্ডের অধীনে রয়েছে ৯৮৭ কলেজ। সেখানে ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৮৮৭ আসন রয়েছে। মাদরাসা বোর্ডের অধীনে ৩২ হাজার ৩৬৪টি কলেজে ৪২ হাজার ৭৪৪টি আসন রয়েছে। তাই আসন সঙ্কট হবে না।

এবার ঢাকা বোর্ডে মোট ৪ লাখ ৩২ হাজার ২০১ জন পাস করেছে। পাস করা শিক্ষার্থীর চাইতে আসন সংখ্যা বেশি রয়েছে। এছাড়াও আট বোর্ডের অধীনে ২১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৯টি আসন রয়েছে। সেখানে এবার ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ শিক্ষার্থী পাস করেছে। সাধারণ বোর্ডেও পাসের চাইতে আসন সংখ্যা বেশি রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ১৩ মে থেকে একাদশে অনলাইন ও এসএমএস-এর মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যা শেষ হবে ২৪ মে। তবে পুনর্নিরীক্ষণে যাদের ফল পরিবর্তন হবে, তাদের আবেদন আগামী ৫ ও ৬ জুন পর্যন্ত গ্রহণ করা হবে। ক্লাস শুরু হবে ১ জুলাই থেকে। জাগোনিউজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫