ইতিহাস ঐতিহ্য ও সবুজে ঘেরা কাপাসিয়া

মোঃ আকরাম হোসেন রিপন ॥
গাজীপুর : ভারত বর্ষের পর্যটনের প্রধান আকর্ষণ যদি হয় আগ্রার তাজমহল, তার গায়ের নিখুঁত হিরার পাথরগুলি যদি হয় তার অলংকার, মোঘল সেনাপতি মানসিং, বাংলার বীর ঈসা খা এবং সমগ্র ভারতের ইংরেজদের ত্রাস সৃষ্টিকারী বীর যদি হয় ফকির মজনু শাহ। বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদ যদি হয় বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম নায়ক। বাংলার ইতিহাসে তবে এ কথা মানতেই হবে, আঁকা বাকা নদী আর সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলা বাংলার অলংকার ও ইতিহাসের ধারক।
প্রাচীন ঢাকা জেলার এই কাপাসিয়া এখন গাজীপুর জেলায় অন্তরভূক্ত। যা প্রাচীনকালে এক সময় পার্শ্ববর্তী কালিগঞ্জ, শ্রীপুর ও মনোহরদী নিয়ে একটি এলাকা ছিল তার নাম কাপাসিয়া। কাপাসিয়া উপজেলা রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৬৫ কি.মি. উত্তর-পূর্বে ঐতিহ্যবাহী শীতলক্ষ্যা নদীর দু’তীরে ১১টি ইউনিয়নের সমন্বয়ে ৯৯টি ওয়ার্ড ২৬৪ টি গ্রাম নিয়ে শালবনে ঘেরা ৩৫৭ কি.মি. জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। কাপাসিয়ার উত্তরে ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও ও কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলা, দক্ষিণে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে নরসিংদী জেলার মনোহরদী ও শিবপুর উপজেলা এবং পশ্চিমে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা।
যে কার্পাস সুতার মাধ্যমে মসলিন তৈরী হতো, তারই আড়ৎ ছিল কাপাসিয়াতে, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হতে হতে আধুনিক কাপাসিয়া হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সুবিখ্যাত মোঘল সেনাপতি মানসিংহ এই খানেই বাংলার বীর ঈসা খার হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর মানসিংহকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করে পাঠালে তিনি ১৫৯৭ খ্রি, ঈসা খার সঙ্গে নৌযুদ্ধে লিপ্ত হন। ঈসা খা বিখ্যাত ও সুরক্ষিত এগারসিন্দুর দুর্গে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে ঈসা খা ও মানসিংহের মাঝে বন্ধুক যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েক দিনব্যাপী সংঘঠিত এ বন্ধুক যুদ্ধে মানসিংহের তলোয়ার ভেঙ্গে গেলে ঈসা খা উদারতা প্রদর্শণ করে। তার হাতের অপর তলোয়ার প্রদান করেন। এতে মানসিংহ পরাজয় স্বীকার করে বুকে জড়িয়ে নেন। ফলশ্রুতিতে আকবর কাপাসিয়াসহ তাকে বাইস পরগোনার জমিদারী প্রদান করেন এবং তাকে মসনদ-ই-আলা উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীকালে মোঘলদের সাথে আরো কিছু সংঘর্ষ হলে ও জাহাঙ্গীর নগরের প্রতিষ্ঠাতা ও বিখ্যাত মোঘল সুবেদার ইসলাম খান বাংলার বারো ভূইয়াদের কঠোরভাবে দমন করেন এবং কাপাসিয়াসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কাপাসিয়াতে রানীগঞ্জের অপর পাড়ে স্বর্ণময়ী দেবী ও ঈসা খার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল। বিয়ের কাবিন দেনমোহর হয়েছিল ১ লাখ টাকা। তারই প্রেক্ষিতে গ্রামের নাম হয়েছে লাখপুর। কাপাসিয়ার লোহাদী গ্রামে মোঘলদের বড় বড় কামান তৈরীর কারখানা ছিল। দার-এ-দরিয়াতে (দরদরিয়া) শাহাবিদ্যার কোর্ট যা রাণী ভবানীর দুর্গ বলেও ইতিহাসে বিদ্যমান আছে। তা আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে অবহেলায় আপন মহিমায় টিকে আছে। কাপাসিয়ার টোক ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে এগারসিন্দুর এখনও তার অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যার্থ প্রয়াসে ধুকে ধুকে মরছে। তাঁরাগঞ্জের একডালার দুর্গ রাণীগঞ্জের নদীর তীরের দুর্ভেদ্য কামান দুর্গ এখনও রয়েছে সমুজ্জল। যদিও একটি কামানও নাই আজ সেখানে। বাংলার প্রবেশদ্বার বিখ্যাত টোক বন্দর, যার আধুনিক নাম টোক। সন্যাসী বিদ্রোহির মহা নায়ক ফকির মজনু শাহের লীলাভূমি ছিল দুর্ভেদ্য দরদরিয়া দুর্গ। সমগ্র ভারতে ইংরেজদের ত্রাস সৃষ্টিকারী বীর, যার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের স্মৃতিধারণ করে গাজীপুরের বৃহত্তর কাপাসিয়ায় শীতলক্ষ্যা নদীর উপর নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে ফকির মজনু শাহ সেতু। এটি সাবেক পাট মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আ স ম হান্নান শাহর অবদান। ফকির মজনু শাহ চির শয্যায় শায়িত আছেন কাপাসিয়ার কপালেশ্বর নামক গ্রামে। বার ভূইয়াদের অন্যতম ফজল গাজীর লীলাভূমি এই কাপাসিয়া, যদিও কাপাসিয়ার দক্ষিণ অংশে গাজীদের অস্তিত্ব এখনো কোন রকমে বেচে আছে।
আটটি ইউনিয়ন যেন এক রোগ নিরাময়ের অষ্টধাতু দিয়ে গড়া। ব্রহ্মপুত্র তার শাখা নদী দিয়ে বেষ্ঠিত দ্বীপ। মহা চীনের বন্ধুত্বকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। চৈনিক পর্যটক ফাহিয়েম ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়েই বাংলার উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বারে অবতরণ করেছিলেন।
বিট্রিশ রাজত্বে মোঘলদের সুবেহ বাংলাকে ভেঙ্গে থানা পর্যায়ে যে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরী হয়েছিল সেই থেকে মসলিনের আদি নিবাস কার্পাস আড়ৎকে কেন্দ্র করেই কাপাসিয়া থানার আধুনিক নামকরন। দক্ষিণে কালিগঞ্জ, পশ্চিমে শ্রীপুর থানা ছিল কাপাসিয়া থানার আওয়াতাভূক্ত। এই ৩ থানা মিলে বিট্রিশের প্রশাসনিক এলাকা ছিল কাপাসিয়া থানা। টুক অধুনা টোক ছিল বিখ্যাত নদী বন্দর। ফাহিয়েমের এ ভ্রমণকাহিনীতে এই টোক বন্দরের বিবরণ জানা যায়। টোকের উত্তরে আধুনিক কিশোরগঞ্জ ছিল আসাম রাজ্যের অন্তরগত। বড় বড় যুদ্ধ বিগ্রহ এই টোক অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, মোঘল রাজ্যের প্রান্তসীমায়।
মোঘলরা তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে কয়েকটি সুবায় এবং সুবায়কে কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত করেছিল। এই অঞ্চলের পরগনার নাম ছিল ভাওয়াল। যেমন ছিল বিক্রমপুর, মহেশ্বরদী ইত্যাদি। প্রত্যেকটি পরগনার ভৌগলিক বৈশিষ্ট ছিল আলাদা আলাদা এবং এটা করেছিলেন টোডমরল নামক এক মোঘল কর্মচারী। আজও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে কাপাসিয়া থানা বাংলাদেশের সবচাইতে সুন্দর ও সুশোভিত অঞ্চল। সাড়া বাংলায় অন্য কোথাও এই ধরনের প্রাকৃতিক ভাবে সুবিন্যাস্ত সুসজ্জিত অঞ্চল নেই। এটা যেন এক প্রাকৃতিক পার্ক। বিধাতার আপন হাতে সাজিয়েছেন একে নানাভাবে নানা ভঙ্গিমায়। এ অঞ্চলে ভূমি বিন্যাস, বৃক্ষরাজী, নদনদী, হাওর, জঙ্গল ও বিল যে কোন সৌন্দর্য্য পিপাসু হৃদয়কে পরিতৃপ্ত দিতে পারে। প্রাণী জগৎ, পক্ষীকুল বৃক্ষরাজী, বনজ সম্পদ ফলমূলে সুসভিত। এখানে যা আছে অন্য কোথাও তা নেই। এমন সব ফলমুল স্থানীয় লোকেরা খেয়ে থাকেন যা অন্য অঞ্চলের লোকজন নামই শোনে নাই। কাপাসিয়া যেন একটি সুসভিত ফলের বাগান। শুধু বাংলাদেশ কেন সমগ্র পৃথিবীতে কাপাসিয়ার ফল রপ্তানি করা হয়। কাপাসিয়ার নিজস্ব ফল রপ্তানি করে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। যদি কেও কাপাসিয়া না ঘুরে দেখেন তবে বাংলাদেশে তার জন্মই বৃথা। ভারবর্ষ ঘুরে দেখলে যেমন সমগ্র পৃথিবীর সাদ পাওয়া যায় ঠিক তেমনি কাপাসিয়ার মাঝে সমগ্র বাংলার রূপ দেখা সম্ভব। তাই এটা হতে পারে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র।
কাপাসিয়ার পর্যটকদের প্রধান আকষর্ণ ধাধার চর হলো মায়াবী দ্বীপ। স্বর্গ আমরা দেখতে পাইনা। তবে আমরা অনুভব করতে পারি। স্বর্গ হচ্ছে সবচাইতে সুন্দর ও আনন্দতম স্থান। যেখানে কোন দুঃখ থাকে না, থাকবেনা কোন ভাবনা, থাকবে না কোন চিন্তা, থাকবে শুধুই আনন্দ। তাহলে আমরা একেও স্বর্গ বলতে পারি। প্রকৃতির সাজানো গুছানো বিচিত্র আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপরহস্যের মহিমায় ভরা এক স¦র্গ। একে যেন বিধাতা আপন হাতে সাজিয়েছেন নানাভাবে নানা ভঙ্গিমায়। এর বাতাসে দোল খাওয়া বৃক্ষরাজি যেন দুঃখে ভরা হৃদয়ে কোমল ভাবে হাত বুলিয়ে দেয়, এই কোমল হাতের ছোঁয়া যার হৃদয়ে পড়েছে, থাকতেই পারেনা তার কোন দুঃখ। এখানে এলে যে কেউ ভুলে যাবে তার কঠিন পৃথিবীটাকে। চতুর্দিকে নদী দিয়ে বেষ্টিত প্রায় সারে চার কিলোমিটার দীর্ঘ বৃক্ষরাজিতে ভরা সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা রানীগঞ্জের ধাধারচর।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রভাবশালী খাদ্যমন্ত্রী ফকির আব্দুল মান্নান এ কাপাসিয়ারই সন্তান। এখানেই জন্ম বাংলার তাজ বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ’র। বাংলাদেশের নাম যদি উচ্চারণ করতে হয় তাহলে বাংলাদেশের নামকরণে সবচেয়ে বেশী যার অবদান তিনি হচ্ছেন এ কাপাসিয়ার গর্ভিত সন্তান বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম এটর্নি জেনারেলে জন্ম এ কাপাসিয়াতেই। যার নাম হচ্ছে ফকির শাহাব উদ্দিন। বাংলার সিংহ পুরুষ বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতারা চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে, তিনি হচ্ছেন সাবেক সফল পাটমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আসম হান্নান শাহ পিএসসি। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহীনিতে চাকুরীরত অবস্থায় থাকাকালীন দেশে ও বিদেশে সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন করেছেন।
কাপাসিয়ার নাম স্মরণ করলে যাদের নাম মনে পড়ে যায় তারা হলেন, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক সভানেত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন, বঙ্গতাজের সুযোগ্য উত্তরসূরী সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। যার কথা না বললেই নয় ইতোমধ্যেই যিনি মাটি ও মানুষের নেতৃ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন বঙ্গতাজ কন্যা সিমিন হোসেন রিমি এমপি। অপরদিকে বাবার স্মৃতিকে বুকে নিয়ে পিতার অসমাপ্ত কাজগোলোকে সমাপ্ত করার প্রয়াসে কাপাসিয়ার মানুষের সাথে মিশে গেছেন হান্নানশাহ্র ছোট ছেলে শাহ্ রিয়াজুল হান্নান।
কাপাসিয়া হল বাংলাদেশের দর্পণ। কাপাসিয়া হতে পরে বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ যে কারো মন কেড়ে নিবে। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় মানুষ সহজেই এখনে আসতে পারে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫