স্টাফ রিপোর্টার ॥
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে একাধিক বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এসব বৈঠকে প্রাথমিকভাবে ৮ হাজারের মতো রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার সরকার। একই সঙ্গে জিরো লাইনে আটকে পড়া আরো ৬ হাজার মানুষকে তারা ফিরিয়ে নিবে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে লাখ লাখ রোহিঙ্গা তাদের বসত ভিটায় ফিরে যাওয়ার আগেই সেখানে গণকবর ও পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি বুলড্রোজারে চাপা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা বা কোনো পরাশক্তি দেশ বিশেষ করে ভারত, চীন ও রাশিয়ার মত দেশগুলো যাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ঘনিষ্ট ও পরোক্ষভাবে তারা রোহিঙ্গা সংকটে ভূমিকা রাখছে তারাও বলতে পারছে না এদেশের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা রোহিঙ্গারা কবে তাদের নিজদেশে ফিরে যাবে। এমনকি রোহিঙ্গারা এখনো দলে দলে নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসছে।
৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া কতটা সহজ হবে এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে ? বিবিসি বাংলার এমন এক প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এক প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটি শুরু হয়েছে এক ভিকিটিমের জবানবন্দী নিয়ে।
সাবিনা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন গত বছর আগষ্টের শেষ সপ্তাহে। স্বামীকে হত্যার পর ২ সন্তান নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন জীবন বাঁচাতে। কিন্তু প্রায় ৬ মাস কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকার পর তিনি এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার দেশ মিয়ানমারের মংডুতে ফিরে যাওয়ার।
সাবিনা জানান, আমাদের সেখানে জমি-জমা আছে। যদি ঘর-বাড়ি অবশিষ্ট থাকে, আর আমাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া হয় তাহলে আমি অবশ্যই সেখানে ফিরে যেতে চাই।
কুতুপালং ক্যাম্পের সেলিম মোহাম্মদ বলছিলেন ‘রিফিউজি হওয়া তো আমাদের উদ্দেশ্য না। মিয়ানমার যদি নিরাপদ হয় তাহলে আমরা চলে যাবো। আমাদের সেখানে জমি-জমা বুঝিয়ে দিতে হবে, ঘর বাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। শুনেছিলাম আনান কমিশনের একটি রিপোর্ট দিয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন হলে আমাদের সেখানে অসুবিধা হবে না বলে মনে করি।’
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি হিসেবে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলে এসেছে মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে তাদের নিজের দেশ অর্থাৎ মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে। ৬ মাস শেষে ফেরত যাওয়া বা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কতখানি এগিয়েছে?
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে গত ২৩ নভেম্বর একটি সমঝোতা স্মারকে একমত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। যাকে ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অফ ডিসপ্লেসড পারসনস ফ্রম রাখাইন স্টেট’’ বা রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত মানুষদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি সমঝোতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
এরপর এই বছরে যারা জানুয়ারীর মাঝামাঝিতে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে এক চুক্তি হয় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৩’শ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিবে। যেদিন থেকে যাওয়া শুরু হবে তার পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে প্রক্রিয়াটি শেষ হবে বলে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলেছেন। দফায় দফায় এসব বৈঠক আর চুক্তি হলেও মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা আসলে কী?
জবাবে কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘এখানে এত অধৈর্য হলে চলবে না। এটি একটি আলোচনা শুরু হয়েছে, অগ্রসর হয়েছে এবং আমরা মাঝপথে আছি। হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। এর আগেও আমাদের দেশে এমন সমস্যা হয়েছে তখনো সময় লেগেছে। এখন যেহেতু সমস্যাটা বেশি তাই সময়টা একটু বেশি লাগবে’।
কিন্তু তালিকায় থাকা সবাই কি জানে যে তাদের ফেরত পাঠানো হবে?
জবাবে মি. কালাম বলছেন ‘আট হাজার ৩২ জনের যে তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠানো হয়েছে সে সম্পর্কে তালিকায় থাকা মানুষেরা কিছুই জানেন না। মিয়ানমার অনুমোদন করলেই সেটা তাদের জানানো হবে।’
অর্থাৎ তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা আদৌ যেতে চান কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
মিয়ানমার রোহিঙ্গা ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের প্রধান রকিবুল্লাহ জানান, প্রত্যাবাসনের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের কাছে খুব কম তথ্য আছে আবার অনেকে এই সম্পর্কে জানেন না।
মি. রকিবুল্লাহ বলছেন ‘এসব আলাপ আলোচনার সময় আমরা যারা রোহিঙ্গা লিডার আছি তাদের সাথে নিতে হবে বলে আমরা মনে করছি। কারণ আমরা যেতে চাই কিনা, কিভাবে যেতে চাই সেটা আমাদের কাছে তাদের জানা দরকার’। তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে একটা সন্দেহ আছে এই প্রত্যাবাসন নিয়ে কারণ আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। যখন তথ্য থাকবে তখন হয়ত এই সন্দেহ থাকবে না।’
মিস্টার রকিবুল্লাহ বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে থাকতে চাই না কিন্তু সঠিক ভাবে আমাদের সব অধিকার নিশ্চিত করে তারপর ফেরত পাঠাতে হবে।’
এদিকে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, মিয়ানমার সীমান্তের জিরো লাইনে আটকে পড়া প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নিতে রাজি হয়েছে।
তবে সব কিছুই এখনো আলাপ আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে, চূড়ান্ত ভাবে প্রত্যাবাসনের কাজ শুরু হতে আরো সময় ব্যয় হবে সেটা কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন।