বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
‘তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তাও ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ দেখি, রাস্তার মাঝখানে ৫০-৬০ সশস্ত্র যুবক দাঁড়িয়ে। হাতে ইট-পাথর, লাঠিসোটা, রড। হকচকিত হয়ে ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি থামাও। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিতে হামলা করল তারা। গাড়ি লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি ইট-পাথর মারতে শুরু করে ওই যুবকরা। আমি গাড়ির গ্গ্নাস একটু ফাঁক করে বললাম, তোমরা এসব কী করছ? না; তারা কোনো কথাই শুনতে চাইল না। আমাকেও লাঠি দিয়ে আঘাত করতে এগিয়ে এলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির গ্গ্নাস বন্ধ করে দিলাম। আর আমাদের ড্রাইভার অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দ্রুত গাড়িটি ঘুরিয়ে পেছনের দিকে চালিয়ে স্থান ত্যাগ করল। না হয় হয়তো সেখানেই আমার এবং অন্য নেতাদের করুণ মৃত্যুবরণের ঘটনা ঘটতে পারত। আর সামনের দিকে গাড়ি চালিয়ে গেলে হামলাকারীদের অনেকেই গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যেত। বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা থেকে রক্ষার জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি।’
এই ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার কথা সমকালকে বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সহায়তা দিতে রাঙামাটি যাওয়ার পথে রোববার চট্টগ্রামের
রাঙ্গুনিয়ায় হামলার শিকার হন তিনি। মির্জা ফখরুলসহ তার গাড়িবহরে থাকা পাঁচজন আহত হন। গতকাল সোমবার দুপুরে উত্তরার বাসভবনে আলাপচারিতায় হামলার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার আঘাতপ্রাপ্ত বাম হাতের দিকে নজর দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘মৃত্যু আজ হোক, কাল হোক- একদিন হবেই। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেভাবে মৃত্যু লিখে রেখেছেন, সেভাবেই হবে। ছাত্রজীবন থেকে এ ধরনের অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। অনেক অভিজ্ঞতাও আছে। তবে আমি ভাবছি আমাদের প্রিয় দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে; গণতন্ত্র নিয়ে। দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতেও বাধা! আমরা কোন সভ্য দেশে বাস করছি!’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, গাড়িতে সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে ছিলেন তিনি। পেছনের সিটে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম। বৃষ্টির মতো ইট-পাথর ছুড়তে শুরু করলে গাড়ির গ্গ্নাস ভেঙে যায়। সবার গায়ে ইট-পাথর পড়ছে। গ্গ্নাস ভেঙে পড়ছে। সবাই বলছিলেন, আল্লাহ তুমি আমাদের রক্ষা কর। এর মধ্যে একটি বড় পাথর সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীমের মাথার পেছনে লাগে। তখন তিনি আর্তচিৎকার করছিলেন আর ভয়ার্ত কণ্ঠে পড়ছিলেন লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা ইন্নিকুন্তু মিনাজ জোয়ালিমিন।
দুর্গতদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার জন্য গাড়ির মধ্যে টাকার ব্যাগ ছিল বলে জানান মির্জা ফখরুল। গাড়িতে একেবারে পেছনের সিটে চট্টগ্রাম ছাত্রদল নেতা গোলাম নবী আপেলের কাছে তার ব্যাগ ও টাকাও ছিল। পেছনের গ্গ্নাস ভেঙে ফেলার পর তাকে লাঠি ও রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটাতে শুরু করে দুর্বৃত্তরা। সে তার ব্যাগটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। জীবন বাজি রেখে গোলাম নবী আপেল টাকা-পয়সা ও ব্যাগ রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
গাড়ির বহর চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মূল সড়ক দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। কিন্তু হঠাৎ রাস্তা পরিবর্তনের বিষয়টি পুলিশের জানা ছিল না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মূল সড়ক দিয়েই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় ওই রাস্তাটি ভেঙে বন্ধ হয়ে গেছে। সকালে মেরামতের কাজ চলছিল। স্থানীয় নেতারা টেলিফোনে রাস্তা ভাঙার বিষয়টি জানালে রাস্তা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকালে আমি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছার পরই রাস্তা পরিবর্তনের বিষয়টি জানতে পারি। সেখান থেকেই চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়ক দিয়ে রওনা হই। স্থানীয় নেতাদের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে অবহিত করার। তারা পুলিশকে অবহিত করেছেন। এমনকি গাড়িবহরের সঙ্গে পুলিশেরও গাড়ি ছিল। আমরা কাপ্তাইয়ের কাছাকাছি চলেও গিয়েছিলাম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, পুলিশের উপস্থিতিতেই বহরে হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার ছবিও তুলেছেন উপস্থিত সাংবাদিকরা।’
হামলার জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত হামলা। কার নির্দেশে তারা হামলা করল? কারও ইন্ধন ছাড়া এত বড় ঘটনা ঘটত না। যে এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটেছে, তা আওয়ামী লীগ নেতা সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদের।
অবশ্য ড. হাছান মাহমুদ অভিযোগ করেছেন, তার নির্বাচনী এলাকার দুই ব্যক্তি ফখরুলের গাড়িবহরের ধাক্কায় আহত হওয়ায় ক্ষুব্ধ জনগণ গাড়িতে হামলা করেছেন। তবে হাছান মাহমুদের এ অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, এসব রাজনৈতিক স্টান্টবাজি এখন আর মানুষ বিশ্বাস করে না।
সরকারের পক্ষ থেকে ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রকৃত সত্য কখনও উদ্ঘাটন হবে না। এ ধরনের ঘটনায় আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে পুরস্কৃত করার নজিরই বেশি। বরং কথিত তদন্তের মাধ্যমে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কথা বলে কিছু নেতাকর্মীর নাম প্রকাশ করার আশঙ্কা বেশি।
এ হামলার ঘটনাকে তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘অন্যায়’ বলেছেন। এ বক্তব্য সম্পর্কে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশি-বিদেশিদের সমালোচনার মুখে এসব কথাবার্তা লোক দেখানোর নামান্তর ছাড়া আর কিছু নয়। এর আগেও লংগদুতে পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুনের ঘটনার পর দলের সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল সহানুভূতি প্রকাশ করতে গেলে বাধার মুখে সেখানে যেতে পারেনি। একই সঙ্গে তিনি এও বলেন, সম্প্রতি মাদারীপুরে দলীয় কর্মসূচি এবং নরসিংদী, মৌলভীবাজার ও নেত্রকোনায় ইফতার মাহফিল ভ-ুল করেছে সরকারি দল। নাটোর, কুমিল্লাসহ কয়েকটি জায়গায় ইফতার আয়োজনের অনুমতিই মেলেনি।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও আন্তর্জাতিক উইংয়ের সদস্য শামা ওবায়েদ উপ¯ি’ত হন ফখরুলের বাসভবনে। তিনি ফখরুলকে জানান, তার গাড়িবহরে হামলার ঘটনার পরপর ঢাকায় অনেক দূতাবাসের কূটনীতিকরা টেলিফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন। বিশেষ করে প্রতিবেশী একটি দেশের নাম উল্লেখ করে দু’তিনবার ফোন করে ঘটনাস্থল ও বর্ণনা জানতে চেয়েছেন বলে জানান শামা। মির্জা ফখরুল তার তথ্য শুনে দূতাবাসের কূটনীতিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।
হামলা সম্পর্কে দেশি-বিদেশিদের খোঁজখবর নেওয়ার বিষয়টি জানিয়ে ফখরুল বলেন, এতে আওয়ামী লীগের লোকসান হয়েছে। ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে। তারা যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না- তার আবারও প্রমাণ মিলেছে। এতে বিএনপির লাভ হয়েছে। জনগণ সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগের এসব ফ্যাসিস্ট আচরণের জবাব দেবে। সমকাল