ভাস্কর্যটি গ্রিক নয়, বাঙালি নারীর: দাবি নির্মাতার

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
সুপ্রিম কোর্টের মূল ফটকের সামনের যে গ্রিক ভাস্কর্য নিয়ে সম্প্রতি বেশ বিতর্ক চলছে সেটি বাঙালি নারীর ভাস্কর্য বলে দাবি করেছেন এর ভাস্কর মৃণাল হক। শুধু তাই নয় ভাস্কর্যটিতে শাড়ি পরা নারীর পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরেছেন এই শিল্পী। যদিও এটি তৈরির সময় তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে ভাস্কর্যটি করা হচ্ছে, যার ডান হাতে একটি তলোয়ার আর বাম হাতে দাঁড়িপাল্লা।  গত ডিসেম্বরে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়, যা জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার উদ্বোধন করার কথা ছিল। তবে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি জানালে বিতর্কের কারণে সেটির উদ্বোধন হয়নি।

সম্প্রতি বেসরকারী টেলিভিশন একাত্তুরে নিজের শিল্পকর্মটি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ভাস্কর মৃণাল হক।

তিনি বলেন, ‘এটা কোনো গ্রিক দেবীর মূর্তি নয়। বরং বাঙালি নারীর ভাস্কর্য। ন্যায়বিচারকের ভূমিকায় বাঙালি নারীর অবয়ব দেখাতে চেয়েছি এই ভাস্কর্যে। বিশ্বজুড়ে বিচারালয়ে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে একটি ভাস্কর্য প্রচলিত আছে। উচ্চ আদালত কর্তৃপক্ষ সেই ভাস্কর্যটির মতো একটি ভাস্কর্য এখানে বানাতে বলেছিল। সেটা করলে আরও বেশি বিতর্ক হতো। তখন বলা হতো এই ভাস্কর্য আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। তাই বিতর্ক থেকে মুক্ত থাকতেই বাঙালি নারীর বেশে শাড়ি পরানো ভাস্কর্যটি তৈরি করি।’

সব ভাস্কর্যকেই মূর্তি হিসেবে দেখার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যেটাকে পূজা করা হয় শুধুমাত্র সেটাকেই আমরা মূর্তি বা প্রতিমা বলতে পারি। এর বাইরে যেগুলো আছে সেগুলো হলো ভাস্কর্য অথবা শিল্পকর্ম। আমাদের মনে হয় এটা একটা এডুকেশনের পার্ট হিসেবে আসা দরকার। তাহলে আমাদের দেশে কখনোই এই বিতর্ক সৃষ্টি হবে না যে কোনটা মূর্তি আর কোনটা ভাস্কর্য।’

ভাস্কর মৃণাল বলেন, ‘মাওসেতুং, লেলিন, বঙ্গবন্ধুর মতো পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মৃতি ধরে রাখার প্রয়োজন আছে। তারা বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। এজন্য প্রয়োজন সেসব গ্রেটম্যানদের ভাস্কর্য তৈরি করা। আর মন্দিরে পূজা করার জন্য কালী, দূর্গা, বুদ্ধ মূর্তির দরকার হয়। সুতরাং এই ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্যটা আমাদের সকলের সামনে তুলে ধরতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের শ্রদ্ধেয় মাদ্রাসার যারা আছেন, উনাদের যদি সব এডুকেশনে ইনভল্ভ করা যায় ৃ। আমাদের মতো বাংলা, ইংলিশ, ইতিহাস, অংক, ব্যাকরণ সব শিখলে উনারা হয়তো বুঝবেন যে আসলে কোনটা মূর্তি আর কোনটা ভাস্কর্য। উনাদের একটু অন্ধকারে রাখা হয়, যার ফলে উনারা কিন্তু এতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি হয়ে, যারা আমাদের ধর্মের নেতৃত্ব দেবেন; তারাও কিন্তু আজকে ভুল শিক্ষা গ্রহণ করছেন।’

ভাস্কর্য তৈরির সিদ্ধান্ত একক না প্রাতিষ্ঠানিক ছিল – এমন প্রশ্নে এই শিল্পী বলেন, ‘আমার মৃনাল হকের এতো বড় সাহস নেই বাংলাদেশের বিচারকেন্দ্র হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টে গিয়ে একটি ভাস্কর্য তৈরি করব। আমাকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দেন। বেশ কয়েকবার ডিজাইন চেঞ্জ করান। খুব রিয়েলিস্টিক ভাস্কর্য ছিল। আমি বললাম এটি নিয়ে অনেকের আপত্তি হতে পারে। কাজেই সরাসরি রিয়েলিস্টিক ফর্মে না গিয়ে আমরা যদি একটু অ্যাবাস্ট্রাক্ট ফর্মে যাই তাহলে হয়তো এটা নিয়ে বাধা আসবে না।’

‘পরে আমি সিমেন্ট বালু ফাইবারগ্লাস এসব দিয়ে রিয়েলিস্টিক ফর্মে কাজটা না করে, একটি স্টেইনলেস স্টিলের পাইপ দিয়ে ভাস্কর্যটি বানাই। যাতে এটা একটু অ্যাবাস্ট্রাক্ট ফর্মে হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে সরাসরি এটা অনেকের চোখে না লাগে। পরে আদালতের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার আমার বানানো ১ ফুট দীর্ঘ মডেলটি দেখে অনুমোদন দেন এবং বর্তমান আকৃতির ভাস্কর্যটি তৈরি করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানান।’

আপনার ভাস্কর্য নিয়েই কেন বার বার আপত্তি আসছে – এমন প্রশ্নে মৃণাল হক বলেন, ‘ঢাকা শহরের নব্বই ভাগ ভাস্কর্যই আমার হাত দিয়ে করা। যার বেশির ভাগই আমি নিজের পয়সা দিয়েই করেছি। বেশিরভাগ জায়গাতেই আমি পয়সা পাইনা, খরচটা আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এর আগে বিমানবন্দরের সামনে লালনের ভাস্কর্য তৈরি করেছিলাম, যা ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর চাপে ভেঙে ফেলায় আমার ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সে লোন শোধ করতে আমার চার পাঁচ বছর লেগেছে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক একটা স্পন্সর করে পয়সা দেয়নি, সেই ঋণ এখনও শোধ করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আমার বিপদের কথা তো বলার কেউ নাই। আমি আজ ঢাকা শহর সাজাতে গিয়ে, নগরের বিউটিফিকেশন করতে গিয়ে, মানুষের ধারণা বদলাতে গিয়ে একার ঘাড়ে সব বিপদ ডেকে নিয়েছি। আমি দেশের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে গিয়ে আসলেই বিপচ্ছগ্রস্থ। এটা তো আমার দায়িত্ব না। সরকারের দায়িত্ব ছিল ঢাকাকে সাজানো, শহরের বিউটিফিকেশন করা সরকারি পয়সা দিয়ে।’

‘আমি আমেরিকা ছিলাম সাত বছর। ওখান থেকে দুই তিন কোটি টাকা এনেছি। সেই টাকা দিয়ে আমি রাস্তাঘাটে ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়ার পিঠে পুলিশ, ময়ূর, এয়ারপোর্ট গোল চত্বরের ভাস্কর্য, নেভির সামনে ডলফিন, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে ভাস্কর্য, বঙ্গবাজারে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, শেরাটনের সামনে ভাস্কর্য – এগুলো আমি কেন বানাতে যাবো? এগুলো তো সরকারের করা উচিত। তারা তো উদ্যোগ নেয় না। আর যখন সরকার কোনো ভাস্কর্য করার উদ্যোগ নেয় তখন কোথা থেকে কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তি চলে আসে। বিশ কোটি, ত্রিশ কোটি, দশ কোটি, আট কোটি টাকার ব্যবসা তারা করে যায়। আমরা তো ব্যবসায়ী না। আমি আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের বিউটিফিকেশনের দায়িত্বে ছিলাম। সেটা ফেলে চলে এসে আমার জন্মভূমির ঋণ শোধ করছি। সবার ধারণা আমি কোটি কোটি টাকার মালিক অথচ আমি লোনে জর্জরিত। কিছু ভাল কাজ করে যে লভ্যাংশ পাই সে লাভের টাকা দিয়ে আমি ঢাকা শহর সাজাই। এগুলো হচ্ছে দু:খের কাহিনী, যা বলতে গেলে অনেক কাহিনী বেরিয়ে আসবে।’

ভাস্কর মৃণাল আরো বলেন, ‘আজকে সবাই ঢাকা শহর সাজাচ্ছেন, নতুন মেয়র সাহেবরা এসেছেন। আজকে আমরা নাই। অথচ এই দশ পনেরটা বছর আমি আমার পকেটের পয়সা দিয়ে কেন ঢাকা শহর সাজিয়েছি? কেন মোড়ে মোড়ে ভাস্কর্য বানিয়েছি, যেখানে আগে জঙ্গল হয়ে পড়েছিল? এগুলো কেউ দেখবে না। আমি আজ একটা কথা বললে, কাল আমার কাজগুলো ক্যানসেল করা শুরু হবে। আমাদের সরকারেরই উচিত মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করা যাতে সবাই বুঝে যে এটা মূর্তি না এটা একটা ভাস্কর্য।’

তিনি বলেন, ‘সব কিছুকে মূর্তি বলে তা সরানোর দাবি মেনে নেয়াটা হবে আত্মসমর্পণ। এরকম দাবি মেনে নিলে দেশে থাকার মতো পরিবেশ থাকবে না।’

এর আগে মঙ্গলবার রাতে গণভবনে ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারী ওলামাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটি সরাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন তিনি।

ভাস্কর্যটির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। বলা হচ্ছে এটা নাকি গ্রিক মূর্তি। আমাদের এখানে গ্রিক মূর্তি আসবে কেন? আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিৎ না। গ্রিকদের পোশাক ছিল এক রকম। এখানে আবার দেখি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। এটাও হাস্যকর হয়েছে।’

শেয়ার করুন

Related News

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫