বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
হেফাজতের সঙ্গে সখ্যের বিষয়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। অনেকের মধ্যে অস্বস্তিও রয়েছে। তাঁরা বলছেন, হেফাজতসংক্রান্ত কৌশল ও সিদ্ধান্ত সরকারের ওপরের স্তর থেকে এসেছে। এ বিষয়ে আগেভাগে প্রকাশ্যে নিজেদের মতামত দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কতটা লাভ হলো, আর ক্ষতির পরিমাণই কী, তা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় সীমাবদ্ধ রেখেছেন তাঁরা।
আওয়ামী লীগের পাঁচজন কেন্দ্রীয় ও পাঁচজন জেলা পর্যায়ের নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। তবে এসব নেতার কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
এর মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতারা হেফাজতের সঙ্গে সখ্য বা তাঁদের দাবি মানার বিষয়ে লাভ-ক্ষতি দুই দিকই দেখছেন। আর মাঠপর্যায়ের নেতারা বিষয়টি নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত ও অস্বস্তিতে আছেন। এ জন্য তাঁদের প্রতিক্রিয়াও মিশ্র।
কেন্দ্রীয় নেতাদের কথায় হেফাজতসংক্রান্ত সরকারের কৌশলে কিছু লাভের বিষয় বেরিয়ে এসেছে। তাঁরা মনে করেন, হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীসহ অনেকেই মনে করেন নারী নেতৃত্ব হারাম। তাঁরা প্রকাশ্যে বক্তৃতায় নারী নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করেন। দাবি আদায়ের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে বসে বৈঠকে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের সেই বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করা গেছে।
ওই নেতাদের মতে, ২০১৩ সালের ৫ মে অভিযান চালিয়ে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের মতিঝিল থেকে উঠিয়ে দেওয়ার পর তারা ব্যাপক অপ্রচারে নামে। গ্রামে-গঞ্জে প্রচার করা হয় যে সরকার শত শত আলেম মেরে ফেলেছে। হেফাজতের সঙ্গে সখ্যের কৌশলের কারণে এখন আর এই অপপ্রচার করতে পারবে না। আর করলেও মানুষ বিশ্বাস করবে না। এ ছাড়া হেফাজত পুনরায় মাঠে নামতে পারে কিংবা তাদের বিএনপি-জামায়াত মাঠে নামাতে পারে, এমন একটা আশঙ্কা ছিল। এখন সেই সম্ভাবনাও কমে গেছে।
গতকাল শনিবার ধানমন্ডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির পরে আল্লামা শফী হুজুর গতকাল (শুক্রবার) এক জনসভায় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান নেওয়াটা লাভ নয় কি?’
ওবায়দুল কাদের লাভ দেখলেও দলের মাঠপর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, হেফাজতবিষয়ক কৌশলে লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্টাও কম ভারী নয়। কারণ, যত দাবিই মানা হোক না কেন, এই গোষ্ঠীর ভোট আওয়ামী লীগ পাবে না। উল্টো কালো দাগ পড়েছে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। এ ছাড়া আহমদ শফীসহ হেফাজত নেতাদের সম্পর্কে ব্যাপক নেতিবাচক বক্তব্য দেওয়ার পর এভাবে কাছে টেনে নেওয়াটাও বিব্রতকর।
দলের কেউ কেউ মনে করছেন, হেফাজতের কারণে প্রগতিশীল নাগরিকদের একটা অংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব তৈরি হতে পারে, যাঁরা আওয়ামী লীগের দুর্দিনে নানাভাবে পাশে থাকেন।
এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক দলের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। গতকালও জোটের শরিক সাম্যবাদী দলের পলিটব্যুরোর এক সভায় বলা হয়, জঙ্গিবাদের রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিভূমি হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের দর্শন। এর সঙ্গে আপস করে সরকার যে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছে, তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। দলটির এই বক্তব্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে।
ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর মধ্যে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত আওয়ামী লীগপন্থী বলে পরিচিত। এরা জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম—দুটিরই বিপক্ষে। তারা গতকাল চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, কওমি সনদের স্বীকৃতি গভীর ষড়যন্ত্রমূলক আঁতাত। ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশনও হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সখ্যে নাখোশ বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
জানতে চাইলে ১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেফাজতের কিছু রাজনৈতিক দর্শন আছে, সেটা আমরা আগেই নাকচ করে দিয়েছি। তাদের সঙ্গে আমাদের আঁতাত বা সখ্যতার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে সরকারে থাকলে অনেক বাস্তবতা মানতে হয়। কওমি সনদের স্বীকৃতি সেই বাস্তবতার অংশ।’
আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতারা বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলার দায়িত্বশীল একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার ও দলের কৌশল ঠিক করেন দলীয় প্রধান। নিশ্চয় তিনি দল ও সরকারের ভালো হবে ভেবেই সব করছেন। তবে দলীয় ফোরামে না হোক, ঘনিষ্ঠ রাজনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
রাজশাহী বিভাগের একজন নেতা বলেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আদর্শের কোনো মিল নেই। ফলে তাদের নিয়ে কোনো কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সমালোচনা হবেই। কিন্তু এই শক্তিটাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারলে আওয়ামী লীগ ও দেশের লাভ আছে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা নিশ্চয় সব দিক বিবেচনা করেই এগোচ্ছেন।
ময়মনসিংহ এলাকার একজন নেতা বলেন, কৌশলগত হোক আর ভোটের জন্যই হোক, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্যের বিষয়টি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় মুখ করে বলার সুযোগ নেই। বরং আলোচনা উঠলে চেপে যেতে হচ্ছে। ভালো-খারাপ তো পরের বিষয়।-প্রথম আলো