তিস্তা নিয়ে ৩৪ বছর আশায় থেকে তোর্সা’র পানি কবে পাবে বাংলাদেশ?

বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা চুক্তির পরিবর্তে তোর্সা সহ অন্য ৩ নদীকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা নাকচ হয়ে গেছে। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় যৌথ বিবৃতিতে মমতার দেয়া তোর্সা ফরমুলার কোনো উল্লেখই নেই। বরং তিস্তা চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নে সমন্বয় সাধনের কথা বলছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।

রোববার সন্ধ্যায় ভারতের পক্ষ থেকে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতির একাংশে বলা হয়, ‘২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে দুই সরকারের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি সই করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেন। মোদি জানিয়েছেন, ওই চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে তার সরকার সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন।’

ওই বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘ফেনি, মনু, ধরলাসহ ৭টি নদীর পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি সইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

এ নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফেনি, মনু, মুহুরী, খোয়াই, গুমটি, ধরলা ও দুধকুমারের পানি ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা শেষ করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এর আগে বলেছিলেন, ‘আপনার তো পানি দরকার। তোর্সা ও আরও যে দু’টি নদী উত্তরবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে গেছে, তার পানির ভাগ ঠিক করতে দু’দেশ কমিটি গড়ুক। শুকনো তিস্তার জল দেয়াটা সত্যিই সমস্যার।’

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে প্রকাশ, মমতার দেয়া বিকল্প প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

মমতার প্রস্তাবে যে কেন্দ্রীয় সরকার অখুশি তা আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় এক মন্ত্রী। তার মতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর চলাকালীন সময়ে এরকমভাবে একটি বিকল্প প্রস্তাব গণমাধ্যমে প্রকাশ করা কূটনীতির পরিপšি’।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেছেন, ‘তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যখন বিবৃতি দিয়েছেন, ঠিক সেই সময়ে প্রকাশ্যে এই নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক হয়নি। বাবুল সুপ্রিয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় মিনিস্টার অব ওয়েটিং’এর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তিন বার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। রাজ্য সরকারকে বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তিস্তা নিয়ে যে এগোবে না, তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর ওই বিবৃতি দেয়ার সময় বাছাটা ঠিক হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশকে যে বড় হারে সহায়তা দেয়া হয়েছে, তা চাপা পড়ে গেল।’

সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য হচ্ছে, ‘এতদিন পর্যন্ত তিস্তার কথা শুনছিলাম, এখন মুখ্যমন্ত্রী তোর্সা এবং আরও কিছু নদীর কথা বলছেন। খাল, বিলকে নদী বলা যায় না! প্রধানমন্ত্রী বলছেন তিনি তিস্তা চুক্তি করবেন, মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আমাকে ছাড়া হবে না।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী কোনো দর কষাকষির চেষ্টা করছেন বলেও অধীর চৌধুরী মন্তব্য করেন।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার তোর্সা প্রস্তাবকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কারণ, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই প্রস্তাব আসেনি। বরং এটিকে মমতার ব্যক্তিগত মত বলেই মনে করছেন তারা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য এবং মতামতকেই দ্বিপক্ষীয় অবস্থানের প্রতিফলন বলে মনে করছে বাংলাদেশ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী আগেই অবশ্য দৃঢ়তার সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনাকে হয়তো এ যাত্রায় মোদির দৃঢ় আশ্বাসকে সম্বল করেই দেশে ফিরতে হতে পারে। আনন্দবাজার জানিয়েছে, তোর্সার পানি কখনওই তিস্তার বিকল্প হতে পারে না। মমতার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, তোর্সার পানি বণ্টনও খুব সহজ হবে না। এজন্য প্রয়োজন আরও সময়। খালও কাটা ছাড়াও সম্ভাব্য জরিপে অনেক সময় লাগবে যা দুটি দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি নিয়ে করা ‘টাইম ফ্রেমের’ বাইরে।

মমতার বিকল্প প্রস্তাবে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনও বিবৃতি দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। তবে দিল্লির মতো বাংলাদেশও মমতার এই প্রস্তাবে গুরুত্ব দিতে চায় না বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার।

প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আনন্দবাজারকে জানান, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী দিল্লিতে আসায় তারা আনন্দিত হয়েছিলেন। সকালে মোদি যেভাবে তাকে পাশে নিয়ে তিস্তা চুক্তি নিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষার আশ্বাস দিয়েছিলেন তাতে স্বস্তিতে ছিলেন তারা। কিন্তু মমতা যে কথা প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, তাতে আনন্দের আর কিছু থাকলো না।

তিনি বলেন, ‘তোর্সার প্রস্তাব বিবেচনার উপযুক্ত নয়। ৩৪ বছর ধরে আলোচনার পরে তিস্তা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা একটা জায়গায় পৌঁছেছেন। তোর্সা নিয়ে আমরা আবার সেই প্রক্রিয়া শুরু করব নাকি?’

বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, তিস্তা ও তোর্সার অববাহিকা এক নয়। তিস্তার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে এই নদীর অববাহিকায় একটা বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তার মধ্যে রংপুর জেলার একটা গোটা বিভাগ রয়েছে। ভূ-প্রকৃতিগত কারণে তোর্সার বাড়তি পানি খাল কেটেও আনা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল থেকে তোর্সা ছাড়া জলঢাকা ও রায়ডাক নদী বাংলাদেশে বয়ে এসেছে। কিন্তু খুব বেশি দূর না এসেই তারা বিভিন্ন নদীতে মিশে যাওয়ায় তিনটি নদীর অববাহিকা ছোট। এই কারণে এগুলো বাংলাদেশে কোনও গুরুত্বপূর্ণ নদী হিসেবেই বিবেচিত হয় না। তিস্তার অববাহিকা কিন্তু অনেক বড়। আর এই অববাহিকায় দ্বিতীয় কোনও বড় নদী না-থাকায় তিস্তার জলের কোনও বিকল্প নেই। তোর্সা, জলঢাকা বা রায়ডাকে ভারত বাড়তি পানি দিলেও তিস্তা অববাহিকার দুর্দশা ঘুচবে না।

তিনি আরও বলেন, ‘যৌথ নদী কমিশন গড়ে ১৯৮৩ সাল থেকে তিস্তা নিয়ে আলোচনা চলছে দিল্লি ও ঢাকার। মমতার প্রস্তাব মেনে তোর্সা-জলঢাকা-রায়ডাক নিয়ে আবার নদী কমিশন গড়ে আলোচনা শুরু করতে হলে, পানি কবে পাবে বাংলাদেশ? সুতরাং সময়ের কারণেও এই প্রস্তাবটি অর্থহীন। কারণ- তিস্তা অববাহিকার যা পরিস্থিতি, তাতে এই অঞ্চলে এখনই পানি না-এলে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।’

এসময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দু’দেশের কূটনীতিকদের কথায় মনে হয়, তিস্তা চুক্তি শুধুই শেখ হাসিনার ভোটে জেতার চাবিকাঠি। এই অঞ্চলের মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি কেউ উল্লেখই করেন না।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, ‘হাসিনার সফরে বিভিন্ন বিষয়ে সাফল্যের মধ্যে একমাত্র মন খারাপের বিষয় তিস্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য। এ যেন ভাত চেয়ে চুইংগাম পাওয়া। বিষয়টি কিভাবে হালকা করা যায়, আমরা এখন সে চেষ্টা করছি।’

এদিকে তোর্সার পানি নেওয়া খুব সহজ হবে না বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে তিস্তা রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন নদী বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদ কল্যাণ রুদ্র।

তিনি মনে করেন, এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে, তোর্সা বা ধরলার মতো নদীগুলো থেকে খাল কেটে বাড়তি জল তিস্তার দিকে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সেটা মুখে বলা যতটা সহজ, কাজে করা ততটাই কঠিন।

বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ডুয়ার্সের গহীন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই খাল কাটতে হবে। আর তাতে পরিবেশ ও ইকোলজির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর তাছাড়া বর্ষায় এই নদীগুলো সব ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে – তাই সে সময় এই পশ্চিমমুখী খাল চালু রাখতে গেলে ভায়াডাক্ট বা অ্যাকোয়াডাক্টও তৈরি করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রযুক্তির দিক থেকে হয়তো এই ধরনের খাল কাটা সম্ভব, কিন্তু কাজটা খুব কঠিন। সার্বিক ইকো-হাইড্রোলজির দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, এবং এর প্রভাব কী হবে সেটা সমীক্ষা না-করে তড়িঘড়ি কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হবে না বলেই আমি মনে করি।’

এছাড়া পরিবেশগত ছাড়পত্র যদি বা মেলেও, প্রকল্পটা শেষ করতেই আসলে অনেকটা সময় লাগবে বলে মনে করেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিদ্যার অধ্যাপক সুবীর সরকার।

তিনি বলেন, ‘সময় কত লাগবে তা নির্ভর করছে অর্থায়নের ওপর, সরকারের ইচ্ছা কতটা জোরালো তার ওপর। খুব তাড়াতাড়িও যদি করা হয়, তার পরেও এই প্রকল্প শেষ হতে বছর কয়েক তো লাগবেই। খাল কাটা ছাড়াও তার আগে গবেষণার প্রশ্ন আছে, পরিবেশগত সমীক্ষার কাজ আছে – এটা আসলে একটা বিরাট প্রকল্প!’
বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশগত সংকট ছাড়াও আরেকটি সমস্যা রয়েছে তোর্সার পানি বণ্টনে। সেটা হলো এই নদীর উৎপত্তি ভুটানে। ফলে দুই দেশের জায়গায় তিন দেশের মাঝেও চুক্তির প্রয়োজন হতে পারে বলে মনে করেন ভারতীয় বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ দেবপ্রসাদ রায়।

তিনি বলেন, তিস্তা শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হলেও তোর্সার উৎপত্তি ভুটানে – ফলে তোর্সার জল ভাগাভাগির ক্ষেত্রে তৃতীয় আর একটি দেশের (ভুটান) মতামতও গুরুত্বপূর্ণ। আনন্দবাজার/ বিবিসি বাংল

শেয়ার করুন

Related News

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫