বাংলাভূমি ডেস্ক ॥
ঢাকা: চীন ৯ লাখ ৭ হাজার মেগাওয়াট, প্রতিবেশী দেশ ভারত ১ লাখ ৮৫ হাজার মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
ভারত-চীনের যখন এই অবস্থা, বাংলাদেশে তখন মাত্র আড়াই’শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কয়লা দিয়ে।
তবে ২০৩০ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভারতও বসে নেই। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের মহাপরিকল্পনা রয়েছে। চীনেও প্রায় ৩০০ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।
বাংলাদেশের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে যারা ঢালাও ভাবে বিরোধীতা করছেন তাদের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এসব তথ্য দিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ঢালাওভাবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য না দিয়ে অন্যান্য দেশের দিকে নজর দেওয়া উচিত। অন্যরা যখন সাশ্রয়ী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা তখন বসে থাকবো কেন। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা তেমন বেশি নেই। বায়ু বিদ্যুতের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এরজন্য যে জমির প্রয়োজন সেখানেও সমস্যা রয়েছে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে এসিড বৃষ্টি হতে পারে, এমন সমালোচনার কড়া জবাব দিয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তাহলেতো ভারতে এসিড বৃষ্টি হওয়ার কথা। আমাদের বড়পুকুরিয়ায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, সেখানেও এসিড বৃষ্টি হওয়ার কথা!
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন নতুন নতুন টেকনোলজি আবিস্কার হয়েছে। আমরা আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল টেনকোলজি ব্যবহার করছি। এতে পরিবেশ দুষণ নেই বললেই চলে। রামপাল নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশে থাকবে সবুজ বেস্টনি। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক ও সজাগ রয়েছেন।
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আন্তর্জাতিকভাবে গভীর বনভূমির ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার আইন আছে। আমাদের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের প্রান্ত সীমানা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
এই এলাকার বায়ুপ্রবাহ সুন্দরবনের বিপরীত দিকে। অর্থাৎ সামান্য পরিমাণ ক্ষতিকারক বায়বীয় পদার্থও যদি নিঃসরণ হয়, তবে তা সুন্দরবনের দিকে নয়, উল্টোদিকে প্রবাহিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী লিখিত বক্তব্যে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় ন্যাশনাল পার্কের এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ভিয়েতনামের হ্যালং বে (উইনেস্কো ঐতিহ্য) এর মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১২০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট যদি এতই দুষণ সৃষ্টি করতো, তাহলে জাপানের মতো দেশ নতুন নতুন কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট তৈরির উদ্যোগ নিতো না। ক’দিন আগে জাপান সরকার ৭০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। চীনে প্রায় ৩০০ কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ কাজ চলছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা দূষণ ভৌগলিকভাবে সীমাবদ্ধ নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কোনো কারণ সুদূর আমেরিকায় ঘটলে, তার প্রভাব আমাদের এখানেও পড়বে। তাহলে আমেরিকা, জাপান, চীন, ভারতকে বলুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ রাখতে।
জাতীয় কমিটির নেতারা বলছেন, আমরা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুতের বিরোধী নই। আমরা রামপালের বিপক্ষে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান হচ্ছে, আমরা সুন্দরবন থেকে নিরাপদ দূরত্বেই করেছি। আর জায়গাটিতে জনবসতি ছিলনা, সে কারণে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে এ বিতর্কের জন্য সরকারকেও অনেকাংশে দায়ী মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন প্রথম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনের কাছে করতে গিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। অন্যগুলোর বিষয়েতো তেমন জোরালো আপত্তি নেই। রামপাল বিরোধী প্রচারণায় কয়লার বিরুদ্ধে নেতিবাচক জনমত তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করছে। ২০২১ সালে ২৪ হাজার, ২০৩০ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় বাংলাদেশ। তেল দিয়ে এতো বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনৈতিকভাবে জটিল।
বর্তমানে তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি খরচ পড়ছে ১৬ থেকে ২০ টাকার মতো, গ্যাসে প্রায় তিন টাকা, আর কয়লায় খরচ পড়ছে পৌনে ৪ টাকার মতো। অন্যদিকে সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ষোল টাকার উপর। এ ছাড়া বাংলাদেশের উর্বর জমিতে অর্থনৈতিকভাবে সৌর বিদ্যুৎ লাভজনক মনে করেন না অনেকেই।
উৎপাদন খরচ অনুযায়ী সাশ্রয়ী হচ্ছে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে বাংলাদেশের গ্যাসের মজুদ। এখনই গ্যাসের ঘাটতির কারণে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালের পর থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকবে। ভবিষ্যতের কথা বলাই বাহুল্য।
সরকার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে আমদানিকরা এলএনজি নিয়ে চিন্তা করছে। কিন্তু তাতেও ১৫ টাকার উপর খরচ পড়বে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এসব দিক বিবেচনা করে সাশ্রয়ী খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা বিকল্প নেই। কোন কারণে তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে এখন যে দামে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে তিনগুন বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হবে। যা নিম্ন আয়ের লোকজনের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।
বিরোধীতার কারণে সরকার দেশীয় কয়লা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছে। এখন যদি আমদানিকরা কয়লা নিয়েও পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। তাহলে গভীর সংকটে মুখে পড়বে বাংলাদেশ। কয়লার বিরুদ্ধে প্রচারণার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে। যার কিছুটা আভাস মিলেছে বাঁশখালীতে। সেখানে প্রস্তাবিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নিয়ে সংঘর্ষে বেশকিছু তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। এ নিয়ে খোদ প্রশাসনও উদ্বিগ্ন।
কয়লা নিয়ে ঢালাওভাবে নেগেটিভ প্রচারণা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেছেন দেশের স্বার্থেই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হওয়া উচিত। বাংলানিউজ