যাত্রাবাড়ীতে যেভাবে নারকীয় তাণ্ডব

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: শুক্রবার (২৩ জানুয়ারি) রাত নয়টা। গুলিস্তান থেকে যাত্রী বোঝাই করে নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছিলো গ্লোরি পরিবহন। রাত সোয়া নয়টায় ডেমরা রোড দিয়ে যাত্রাবাড়ি কাঠেরপুল আসতেই হঠাৎ বাসটির কয়েকগজ সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা।

সামনে বিস্ফোরণ হয়েছে দেখে চালক গতি কমিয়ে বাসটির মোড় ঘুরাতে চান। কিন্তু ভাগ্যের চাকা যেনো ঘুরানো গেলো না! ককটেল বিস্ফোরণের পরই দুর্বৃত্তরা যাত্রীদের ভেতরে রেখেই বাহির থেকে নারকীয়ভাবে পেট্রোল বোমা হামলা চালায় নিরাপরাধ যাত্রীদের উপর। হামলার সেকেন্ড ব্যবধানের মধ্যে পুরো বাসের ভেতরেই আগুন ধরে যায়। ঝলসে যায় অধিকাংশের শরীর। শরীরে আগুন নিয়ে কেউ তখন জানালা ভেঙ্গে বের হয়। কেউবা আগুনের লেলিহান শিখা ভেদ করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন।

শুক্রবার মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিলেন কয়েকজন দগ্ধ।

পেট্রোল বোমা হামলায় মুহূর্তেই দ্বগ্ধ হয়ে যান ২৯ জন নিরপরাধ মানুষ। অবরোধের বলি হয়ে ঝলসে যাওয়ারা এখন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নয়জনের শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ঘটনার সময় প্রত্যক্ষদর্শী আমজাদ বাংলানিউজকে বলেন, আমি কাঠেরপুল দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাত্রাবাড়ি যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি বাসে আগুন। গ্লাস ভেঙ্গে কেউ বের হচ্ছেন, কেউবা দরজা দিয়ে। যেসব যাত্রী নামছিলেন সবার গায়েই আগুন। পুরো দৃশ্যটি ভয়ঙ্কর!

তিনি বলেন, তাদের বাঁচানোর জন্য যে তাৎক্ষণিক গোটা দশেক লোক হবে তাও না। যাত্রীদের অনেকেই আগুন নেভাতে রাস্তায় গড়াগড়ি করছেন। কেউবা দিগ্ধিদিক ছুটছেন। আমিসহ আরও কয়েকজন বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করি। কয়েকজনের আগুন লাগা পোশাক খুলতে চেষ্টা করি।

নির্জন স্থান বেছে নেয় দুর্বৃত্তরা
যে স্থানে ঘটনাটি ঘটেছে সে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, যে স্থানে পেট্রোল বোমা হামলা করেছে সে জায়গাটি অনেকটা নির্জন এবং অন্ধকার। রাস্তার দুই পাশে ডোবানালা ও ফাঁকা জায়গা। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অতর্কিত নারকীয় হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার আশেপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলো না।

যাত্রী মোশাররফ হোসেন (৩৬) জানান, তিনি বাসের ডান পাশে বসেছিলেন। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন কিশোর ও যুবক পেট্রোল বোমাটি ছুড়েই পালিয়ে যায়। আগুনের কারণে তাদের চেহারা দেখতে পারেননি তিনি।

আহাজারিতে ভারি বার্ন ইউনিট
ঘটনার পর ঢামেকের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে চিৎকার, আর্তনাদ, আহাজারি। ঝলসে যাওয়া মুখ দেখে স্বজনদের অনেকেই মুর্ছা যাচ্ছেন। খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন বার্ন ইউনিটের ঊর্ধ্বতন চিকিৎসকেরাসহ অনেকেই।

বাসটিতে থাকা রূপগঞ্জ মুরাপারা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজমুল বার্ন ইউনিটে তার বাবাকে বিলাপ করছেন, ‘আমি বাঁচবো না বাবা। অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে বাবা। আমি সহ্য করতে পারছি না।’এসময় তারা বাবা কাঁদতে কাঁদতে তার ছেলেকে বলেন, ‘একটু সহ্য করো, আব্বু সোনা। ঠিক হয়ে যাবে।’

দগ্ধ হারিছ মিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলেন, এ দুই হাতে কামাই করে আমি বৌ-বাচ্চারে খাওয়াই। আমি সংসারের উপার্জনকারী। আমার সব শেষ। আল্লাহ তুমি বিচার কর।

শুক্রবার রাতে বার্ন ইউনিটে দগ্ধ এবং স্বজনদের কান্নায় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

জানালা ভেঙ্গে বের হন বেশিরভাগ যাত্রী
গ্লোরি পরিবহনে (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৪৮৮৬) পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের পর আগুনের মধ্যেই যাত্রীরা জানালা ভেঙ্গে বের হন। বাসটির যাত্রী জাতীয় বাস্কেটবল দলের সদস্য ও সিটি গ্রুপের কর্মকর্তা তাকদির ইসলাম সেতু জানান, গ্রামের বাড়ি যেতে তিনি গুলিস্তান থেকে বাসে উঠেছিলেন। বাসের বাম পাশে বসেছিলেন। ডান পাশের জানালা দিয়ে একটি পেট্রোল ছোড়া হয় বাসের ভেতর। মুহূর্তের মধ্যে পুরো বাসে আগুন ছড়িয়ে যায়। যাত্রীরা জানালার কাঁচ ভেঙে বের হন।

দগ্ধ জয়নাল আবেদিন মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, আমি নিউমার্কেটে একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করি। কাজ শেষে বাসে করে নারায়ণগঞ্জের আড়াই হাজারের বাসায় যাচ্ছিলাম। কাঠেরপুল এলাকায় আসতেই হঠাৎ বাসের ভেতর কি যেনো ঢুকে পড়লো। তারপর পুরো বাসে ধাউ ধাউ করে আগুন। জানালা ভেঙ্গে আমি বের হয়েছি।

অপর বাসযাত্রী আল-আমিন জানান, তিনি মেয়ে দেখার জন্য ডেমরায় যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তার দুই খালুসহ পাঁচজন ছিলেন। তার দুই খালুই দগ্ধ হন। অপর তিনজন জানালা দিয়ে লাফ দিতে গিয়ে আহত হয়েছেন।

২০ দলীয় জোটের অবরোধের মধ্যে শুক্রবার রাত সোয়া ৯টার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনে (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৪৮৮৬) পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বাসের কমপক্ষে ২৯ জন যাত্রী দগ্ধসহ মোট ৪৭ জন আহত হয়েছেন। দগ্ধরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। এছাড়া আহতদের স্থানীয় কয়েকটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

ঢামেক বার্ন ইউনিটের সাবেক পরিচালক ডা. সামন্তলাল সেন ও প্রফেসর সাজ্জাদ খন্দকার জানিয়েছেন, আমরা তিনজন নারীসহ ২৯ জন দগ্ধ রোগী পেয়েছি। এর মধ্যে নয়জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে।

যাত্রাবাড়ী ছাড়াও শুক্রবার রাজশাহীর পবা ও তানোরে বাসে পেট্রোল বোমায় আরও ১০ জন দগ্ধ হয়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ১৮তম দিনে ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে কমপক্ষে ৪০ জন দগ্ধ হয়েছেন। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫