বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥
ঢাকা: দেশে সারা বছরে যে ফসল হয়, তার প্রায় ৮০ শতাংশ উৎপাদিত হয় ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই চার মাসে। আমন ধান বেচাকেনার মোক্ষম সময় এখন। মাঠে বোরোর চারা প্রস্তুত, গম ও আলুর ভরা মৌসুম হচ্ছে জানুয়ারি। হরেক রকম সবজি, ভুট্টা ও সরিষা চাষের সময়ও এখন। বোরোর জন্য সেচ ও সারের এখনই প্রকৃষ্ট সময়।
কিন্তু অবরোধের কারণে কৃষকের কাছে তেল, বীজ ও সার পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে। টানা চার বছর আমন ধানের দাম পাচ্ছেন না কৃষক। ঘামঝরানো কষ্টের সবজি ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে।
লাগাতার অবরোধ-হরতালে চাহিদা ও সময়মতো সার-ডিজেল পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না কৃষকের। এরই মধ্যে নন-ইউরিয়া সারের দাম বেড়েছে বিভিন্ন স্থানে। অনেক স্থানে মজুদ থাকলেও অবরোধ-হরতালের বাহানা তুলে দ্বিগুণ দাম নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, এ সময়ে যদি কৃষক উৎপাদনে বাধা পান, তাহলে তার নেতিবাচক ফল সারা বছর ভোগ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তায় সংকট তৈরি হবে। তিনি বলেন, খাদ্যশস্য ও কৃষি উপকরণ সরবরাহের বিষয়টি অবরোধের আওতার বাইরে রাখা উচিত।
দেশে চালের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো থেকে। তাই প্রয়োজন মতো সার ও সেচের জ্বালানি না পাওয়া গেলে এ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় চালের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।গত এক সপ্তাহে প্রতি মণ ধানের দাম ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।
সবজি বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না। মাঠে মাঠে শীতের সবজি গড়াচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে। মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় তা ভোক্তাদের কাছে ঠিকমতো পৌঁছানো যাচ্ছে না। আবার শহরে যারা চাল ও সবজি কিনে খান, তাদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে চালের দাম ৪ থেকে ৯ শতাংশ বেড়েছে। জেলেরা অবরোধের কারণে মাছ নিয়েও পড়েছেন বিপাকে।
এখন মাছের ভরা মৌসুম। খাল-বিলে পানি কম, তাই প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। বিপুল পরিমাণ দেশীয় জাতের মাছ প্রতিদিন পচে যাচ্ছে। সারাদেশে দুধ পরিবহনেও সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছে দুগ্ধ খামারি কল্যাণ সমিতি। টানা অবরোধ-হরতালের কবলে পড়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে টমেটোর দাম কমেছে মণে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
বগুড়ায় কৃষক মুলা ও ফুলকপি গরু-ছাগল দিয়ে খাওয়াচ্ছেন। নীলফামারীতে কৃষক নামমাত্র দামে আলু বিক্রি করছেন। এ চিত্র প্রায় সারাদেশের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মন্তাজুল করিম বলেন, যে কৃষক রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে জমিতে ফসল ফলিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন, সেই কৃষক আজ সর্বনাশা রাজনীতির বলি হচ্ছেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, চার বছর ধরে কৃষক ফসলের দাম না পাওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) কমেছে। এবার আমনের আগে ধানের দাম বাড়তির দিকে ছিল। ফলে কৃষক ও অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
বোরো চাষের জন্য প্রয়োজনীয় এক লাখ ২০ হাজার টন বীজের ৬০ শতাংশ বিএডিসি ও বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে থাকে। সরবরাহ সংকটের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে বীজের অভাব দেখা দিয়েছে। এ সুযোগে ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি বীজ ১০ থেকে ২০ টাকা বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। তাও সব কৃষক পাচ্ছেন না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার ফারুক জানান, জেলা পর্যায়ে বীজের যথেষ্ট মজুদ থাকলেও অবরোধের কারণে অর্ধেকের বেশি উপজেলায় সময়মতো বীজ পৌঁছানো যাচ্ছে না।
অবরোধে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সার সরবরাহে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেক স্থানে সাবডিলাররা সারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সার ও বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের ঢাকা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক চান মিয়া জানান, বর্তমানে ইউরিয়া খুচরা মূল্য প্রতি বস্তা ৮০০ টাকা, টিএসপি এক হাজার ১০০, এমওপি ৭৫০ ও ডিএপি এক হাজার ২৫০ টাকা। কিন্তু অবরোধ-হরতালে এসব পণ্যের পরিবহন ব্যয় বেড়েছে।
বর্তমানে উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধান রোপণ শুরু হয়েছে। জমি প্রস্তুতের জন্য ইউরিয়া সার ও সেচের জন্য ডিজেল দরকার হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় ডিলাররা ইউরিয়া সারে বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, অবরোধের কারণে সার পরিবহনে ব্যয় বেড়েছে।টানা অবরোধের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী, দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ডিপো থেকে ডিজেল সরবরাহ প্রায় বন্ধ।
দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলায় এ সময়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ডিজেলের দরকার হয়। ডিসেম্বরে ১৬টি জেলার জন্য প্রয়োজনীয় ৬০ হাজার টন সার সরবরাহ হয় বাঘাবাড়ী ঘাট দিয়ে। এ ঘাটে বর্তমানে ৫০ হাজার টন সার পড়ে আছে খালাসের অপেক্ষায়। অথচ গত বছর একই সময়ে ওই সারের ৯০ শতাংশই উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ডিলারদের কাছে পৌঁছানো হয়েছিল।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি সেচ মৌসুমে সারাদেশে ১৭ লাখ টন ডিজেল সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত বোরোর সেচ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডিজেলের চাহিদা প্রায় পাঁচগুণ বেড়ে যায়।
বোরো আবাদের সেচ মৌসুম শুরু হয়েছে গত ১ ডিসেম্বর। কিন্তু দেশজুড়ে টানা অবরোধ ও বিভিন্ন জেলায় হরতালের কারণে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
কৃষক সেচযন্ত্র চালাতে পর্যাপ্ত ডিজেল পাচ্ছেন না। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেলের পাঁচটি ডিপোতে ডিজেলের মজুদ কমে এসেছে। এর মধ্যে রাজশাহী ও হরিয়ানা ডিপো রেলওয়ের ওয়াগননির্ভর হওয়ায় এ দুটি ডিপো এখন তেলশূন্য।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, এবার সেচ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে ডিজেলের চাহিদা ধরা হয়েছে চার লাখ ২৬ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারিতে চাহিদা ধরা হয়েছে ৬০ হাজার টন। অবরোধের কারণে শুরুতেই চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। গত কয়েক দিনের হরতাল-অবরোধের কারণে উত্তরাঞ্চলে ডিজেল বিক্রি কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।
এদিকে, সেচকাজের জন্য রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, নওগাঁসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রতিদিন ডিজেলের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সরবরাহ সংকটে কৃষক জ্বালানি পাচ্ছেন না।
এদিকে, গতকাল এক বিবৃতিতে গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযানের (সিএসআরএল) সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক কৃষি উপদেষ্টা ড. সিএস করিম সবজিসহ কৃষি পণ্যবাহী যানবাহন অবরোধের আওতামুক্ত ও প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় যানবাহন চালানোর উদ্যোগ নিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন। বেঙ্গলিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম ডেস্ক