স্পোর্টস ডেস্ক ॥ নীরবে নিভৃতে আরও একটি হার টাইগারদের। এমনভাবে পরাজয়টা জেঁকে বসবে বাংলাদেশের জন্য, তা হয়তো কোনো বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমী দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। আর এ কঠিন সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকট টিমের ‘ব্র্যান্ড প্লেয়ার’ সাকিব আল হাসানকে খুব মিস করছে দেশের কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকরা।
কেননা এই সাবিকের নেতৃত্বেই যে বিদেশের মাটিতে ২০০৯ সালে প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। তাও আবার এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই। সেবার দুই টেস্ট, তিন ওয়ানডের প্রতিটিতেই নাস্তানাবুদ হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ইতিহাস সৃষ্টিকারী ওই সিরিজ ছিল কেবলই সাকিবময়। বাঁহাতি এ অলারাউন্ডারের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে প্রথমবারের মতো টেস্টে কোনো দলকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। ব্যাট হাতে ১৫৯ রান ও বল হাতে ১৩ উইকেট নিয়ে সিরিজ-সেরা হয়েছিলেন সাকিব।
টেস্ট তো বটেই, ওয়ানডে সিরিজেও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ধবলধোলাই করেছিল বাংলাদেশ। আর এতেও সিরিজটা সাকিবময় হয়েই ছিলো।
সিরিজের সব পুরস্কার এসেছিল বাংলাদেশের ঘরে। পুরস্কার বলতে স্পনসর ডিজিসেলের সৌজন্যে একটা করে ব্ল্যাকবেরি।
সে সময় বোর্ড পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি তাই রসিকতা করে বলেছিলেন, ঢাকায় গিয়ে ব্ল্যাকবেরির একটা শো রুম দেওয়া যাবে! আর এ শো রুমের কৃতিত্ব যে সাকিবেরই।
এরপর অনেক জল যেমন গড়িয়েছে। ঠিক তেমনি সাকিবও হয়েছেন রাজা থেকে মহারাজা। বাংলাদেশের আইকন থেকে বিশ্ব আইকন। পালক যোগ হয়েছে এক সঙ্গে ক্রিকেটের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণে এক নম্বর হওয়া ও এর স্থায়ীত্বেরও। সাকিবের নৈপূণ্যে দুই-দুইবার কলকাতা নাইট রাইডারর্স (কেকেআর) হয়েছে আইপিএল চ্যাম্পিয়ন।
সাকিব ছাড়া বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সিরিজ। তার এই অনুপস্থিতি কতটুকু ভুগিয়েছে দলকে এবার? সত্যিই কি সাকিবকে খুব বেশি মিস করেনি টাইগাররা?
এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সাকিব থাকতেও আমারা ভালো খেলিনি। গত সাত মাস সাকিব যখন দলের সঙ্গে ছিল, তখনও আমরা হারের বৃত্ত থেকে বের হতে পারিনি। তবে সাকিব এ দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা।
ফারুক আহমেদ বলেন, সাকিব দলে থাকলে এই খারাপ পারফরমেন্স পরিবর্তন হতে পারতো কিনা তা বলতে পারছি না। কিন্তু সাকিব আমাদের অপশন। সে দলে থাকা মানে একটা ব্যাটসম্যান ও একটা বোলারের কাজ একজনেরই করা। এ ক্ষেত্রে আমারা হয় তো দলের প্রয়োজন বুঝে অতিরিক্ত বোলার বা ব্যাটসম্যান খেলাতে পারতাম। এ সুযোগ দলে সৃষ্টি হতো শুধু সাকিব থাকলেই।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বলেন, আমাদের দলের বেস্ট প্লেয়ার সাকিব। সে না থাকাতে কিছুটা মিসিং তো আমাদের মধ্যে আছেই। তবে তার তো ইনজুরিও হতে পারতো, এ সংক্রান্ত কারণেও তো সাকিব অনুপস্থিত থাকতে পারতো। সুতরাং এ বিষয়টি নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই, যেহেতু এটা একটি সাসপেনশন কেস। তবে সাকিব সেরা খেলোয়াড়, তার অনুপস্থিতি মনে পড়বেই।
এদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬ ম্যাচে ৫৩.২০ গড়ে ৫৩২ রান করেছেন সাকিব। বাংলাদেশের পক্ষে এটাই সেরা। এদিক দিয়েও তো এগিয়ে এই মহাতারকা। বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলায় দু’দলের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিক তিনি। রানের দিক দিয়ে সাকিবের ওপরে শুধু ক্যারিবিয়ান শিবনারায়ণ চন্দরপল।
২০০৯ এর পর পাঁচ বছর পরে আবার আরেকটি ক্যারিবিয়ান সফর বাংলাদেশের। বহু হিরণ্ময় স্মৃতি নিয়ে শুরু করা প্রথম ম্যাচেই হারতে হলো। এরপর বাকি দুই ওয়ানডেতেও হার। দুই টেস্টের প্রথমটিতে ইনিংসে হারতে হারতে মাত্র ১২ রান বেশি করে সে লজ্জা নিবারণ হয়েছে। তবে ফলাফল বিশাল ব্যবধানে (১০ উইকেটে) হার।
ঢাকা ব্যাংক কাপ নামের প্রথম ওয়ানডে সিরিজের ট্রফি উন্মোচন অনুষ্ঠান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের প্রেস কনফারেন্স রুমে। এর কিছু সময় পর দুই অধিনায়কের সংবাদ সম্মেলন। বাংলাদেশের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক সাংবাদিক প্রথম প্রশ্নটাই করলেন সাকিবকে নিয়ে!
তার প্রশ্ন, সাকিব নেই, তাকে কতটা মিস করবে বাংলাদেশ দল? এ প্রশ্নের জবাবে অধিনায়ক মুশফিক বলেন, গত আট-দশ বছর ধরেই সে (সাকিব) আমাদের সেরা খেলোয়াড়। তাকে অবশ্যই মিস করব।
অধিনায়কের ভাষায়ও ফুটে উঠলো সে চিত্র। সাকিবকে যে আসলেই মিস করছে পুরো বাংলাদেশ দল, তা তো মুশফিকের কথায়ই স্পষ্ট।
পূর্ণাঙ্গ এ সিরিজে সাকিব থাকলে সমীকরণটা অন্য রকম হতেই পারত বলে মনে করেন এ দেশের লাখো ক্রিকেট ভক্ত। বিশ্বমানের এই ক্রিকেটার দলে থাকা মানেই দলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ দলে ভরসার এক কাণ্ডারি হিসেবে দিক না হারাবার সাহস যে সাকিবই।
এর আগে চলতি বছরের মে মাসে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) কলকাতা দলের অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর সাকিবকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘সাকিব ইজ এ রিয়েল গেম চেঞ্জার’।
হয় তো এ সিরিজেও সেই সাকিব থাকলে গেম চেঞ্জ হতেও পারতো বলে মনে করেন বাঙালি ক্রিকেট পাগল লাখো মানুষ।
এমনই একজন ক্রিকেট পাগল ব্যক্তি প্রিন্স। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের একজন অন্ধ ভক্ত। নিজেকে সেভাবেই দাবি করেন তিনি। দেশে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাচে তার উপস্থিতি। পেশায় তিনি একজন টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা।
সাকিব এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বর্তমান সিরিজ প্রসঙ্গে তিনি সম্প্রতি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখেন, এ বছর শুধুই হার বাংলাদেশর। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জয়ের বড় আশা করেছিলাম। ঠিক যেন চাতক পাখির মতো। তবে জয় তো আসছেই না বরং স্মরণ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণ, বাংলাদেশর জান সাকিব আল হাসানের কথা। হয় তো- হয় তো এই ক্রিকেটার দলে থাকলে মোড় অন্যদিকেও নিতে পারতো। আর এই সাকিব যে আমাদেরই সম্পদ। মিস ইউ সাকিব…
প্রিন্সের মতো এমন লাখো লাখো ক্রিকেট ভক্ত রয়েছেন যারা এই সিরিজে মিস করছেন সাকিব আল হাসনকে। যারা কিনা সাকিবকে পছন্দ করেন এই বাংলাদেশের জন্যই। কারণ তিনি যে এ দেশের সম্পদ। তাদের খারাপ লেগেছে সাকিবহীনতায়। খারাপ লেগেছে দলের পরাজয়ে।
এতে একের পর এক দুঃস্বপ্নের রাতই পার করছেন বাংলাদেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমীরা। হয়তো, সাকিব থাকলে কিছু একটা করতে পারতেন। হয়তো হারের বৃত্ত থেকে বের হবার ক্ষণ একটু কম দীর্ঘায়ু হতো। দীর্ঘ পরাজয়ের নীল বিষে জর্জরিত বাংলাদেশ দলে ফের ফিরে আসবেন কোটি মানুষের প্রিয় তারকা সাকিব