গাড়িতে কালো কাচ: অভিযানের পরিণতি যদি হয় ঘুষ!

বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ অপহরণ খুন, গুম ও হত্যা প্রতিরোধে সারা দেশে অ্যাম্বুলেন্সসহ সব গাড়িতে কালোকাচ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। গত ১০ মে এসব কাচ অপসারণের সময়সীমা শেষ হয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে কালোকাচের গাড়ি কমেনি। গতকাল রোববার থেকে অভিযান শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রথম দিনে বেশ কিছু মামলা হয়েছে এবং শতাধিক গাড়ি রাস্তা থেকে সরিয়েও দেয়া হয়েছে। তবে ভিআইপিরা কালোকাচের গাড়ি চালানোর স্পেশাল অনুমতি পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এ তৎপরতা হয়ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু ট্রাফিক আইন ভাঙার কারণে যেসব মামলা হয় সেগুলোর জরিমানা দিলেই খালাস পাওয়া যায়। মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, ভুয়া লাইসেন্স, যত্রতত্র পার্কিংসহ ইত্যাদি অপরাধে রাজধানীতে প্রতিদিনই মামলা হয়, কিন্তু সেসব অপরাধ কমে না। যৎসামান্য জরিমানা অথবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিলেই খালাস পাওয়া যায় বলে এ ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না। নিরাপত্তার স্বার্থে বেআইনি কালো কাচ নামিয়ে ফেলার এ নির্দেশের নিয়তিও সেই দিকে এগুচ্ছে কি না তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ট্রাফিক পু্লশিদের ঘুষ খাওয়ার নতুন রাস্তা খুলে গেল কি না তা নিয়েও কথা উঠছে। ইতিমধ্যে চালকদের কাছ থেকে এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বেঁধে দেয়া সময়সীমা গত ১০ মে শেষ হয়েছে। কিন্তু রোববার মেয়াদ শেষের দুই দিন পরেও রাজপথে কালোকাচের গাড়ির সংখ্যা আদৌ কমেনি। অনেক চালক নির্দেশনার কথা জানেন না, চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় সাদা কাচ পাওয়া যাচ্ছে না- এসব অজুহাতে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। অবশ্য এ ব্যাপারে সরকারের প্রচারণাও যথেষ্ট ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। আর এ কৌশল কতোটা কার্যকর তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এ ব্যাপারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নুর খান লিটন বলেন, ‘আমি জানি না সাধারণ মানুষ এতে কতোটা উপকৃত হবেন। যদি শুধুমাত্র ভিআইপিরা অনুমতিক্রমে কালো কাচ সম্বলিত গাড়ি ব্যবহার করে তাহলে হয়ত সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যদি এ গাড়ি ব্যবহার করে তাহলে এ আইনের কোনো দরকার নেই। কারণ সর্ষের মধ্যে যদি ভূত থাকে তাহলে আপনি তাড়াবেন কীভাবে?’

তিনি আরো বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে যে সময়ের প্রক্ষাপটে এ আইন সাধারণ মানুষ এর জন্যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী করছেন। এ রকম আইন তো এর আগেও হয়েছে। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র জরিমানা বা ফাইন করবে এর বেশি কী করবে আমার ধারণা নেই। ২৭ বছর আগে এরকম একটা আইন হয়েছিল, মামলা করেছিল, জরিমানা নিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে এটা কার্যকর হয়নি।’

এ ব্যাপারে ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের ন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি অফিসার মারুফ রহমান বলেন, ‘সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়াই এটা শুরু করা ঠিক হয়নি। নিয়ম ভেঙেই কালো কাচ লাগানো গাড়ি রাস্তায় চলছে। তারপরও বর্তমান পরিস্থিতিতে যেহেতু সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে, এটা চালিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু পুলিশের কোনো উদ্যোগই তো শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে না।’

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ট্রাফিক) সূত্র মতে, গতকাল রোববার অভিযানের প্রথম দিনে ঢাকা শহরে অভিযান চালিয়ে ৯৭৩টি কালোকাচ লাগানো গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ১০৬টি যানবাহনকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়া (রেকারিং) হয়েছে।

সোমবার শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসের সামনে কালোকাচ লাগানো গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। বিজয়নগর মোড়ে সমবায় অধিদপ্তরের একটি গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘এখনও কোনো পুলিশ আমার গাড়ি আটক করেনি। আর এটা তো সরকারি গাড়ি। অফিস থেকে বললে গাড়ির কাচ বদল করা হবে।’

এদিকে অনেকে অভিযোগ করছেন, অভিযানের নামে বিভিন্ন মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ তাদের হয়রানি করছে। মামলার হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করছে।

এমননি অভিযোগ করলেন বিজয়নগরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অ্যাম্বুলেন্সের চালক। চালক আক্কাস বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমি গাড়ির গ্লাস পরিবর্তন করতে বিজয়নগরে আসছিলাম। কাকরাইল মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি আটক প্রথমে ২৫শ টাকার কেস দেয়ার কথা বলে। পরে ২০০ টাকা নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দেয়। এখন গ্লাস পরিবর্তন করবো।’

পল্টন মোড়ে গিয়ে দেখা গেল, কালোকাচ লাগানো বেশ কিছু গাড়ি চলাচল করছে। এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশ মোস্তাফিজের কাছে জানতে চাইলে
তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমাদের এখানে গাড়ি চেক করা হচ্ছে না। আপনি সুগন্ধা মোড় অথবা হাইকোর্ট মোড়ে যান। ওখানে বড় অফিসার আছেন আপনাকে তথ্য দিবেন।’

হাইকোর্ট মোড়ে চেকিংয়ের তত্ত্বাবধায়ক ট্রাফিক সহকারি পুলিশ কমিশনার (রমনা অঞ্চল) মোল্লা তবিবুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরের দক্ষিণ জোনে ব্যস্ত এলাকাগুলোতে যেমন- হাইকোর্ট মোড়, সুগন্ধা মোড়, নিউমার্কেট ও ধানমণ্ডি এলাকায় এ অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়া আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি মোড়ে এ অভিযান পরিচালনা করো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘হাইকোর্ট মোড়ে সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ২৫টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়াও সরকারি গাড়িও রয়েছে। আমরা শুধুমাত্র গ্লাসে টিনটেড পেপার বা মার্কারি পেপার ব্যবহৃত গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করছি। যে গাড়িতে তৈরি থেকে কালোগ্লাস ব্যবহৃত সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি না। এছাড়া মন্ত্রী, সচিব এবং ভিআইপি ব্যক্তির গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে আলাদা কথা। অনেকেই আবার অনুমতি নিয়ে চালাচ্ছেন।’

জরিমানা সর্ম্পকে তিনি বলেন, ‘মোটরযান আইনের ১৫১ ধারায় সর্বনিম্ন জরিমানা ১ হাজার ২৫০ টাকা করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কালো কাচ লাগানো গাড়ির কাগজপত্র রেখে দেয়া হয়েছে। কাচ বদল করে আসার পর মালিককে কাগজপত্র ফেরত দেয়া হচ্ছে।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বাংলামেইলকে বলেন, ‘সরকারি হোক বেসরকারি হোক কালো গ্লাস ব্যবহৃত প্রতিটি গাড়ি ধরা হচ্ছে। স্বররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় দ্বিতীয় দিনও অভিযান অব্যাহত আছে। আজ (সোমবার) কতগুলো গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে সন্ধ্যার মধ্যে গণমাধ্যমে জানানো হবে।’

এ অভিযানের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ট্রাফিক পুলিশের ডেপুটি কমিশনার খান মুহাম্মদ রেজওয়ান বাংলামেইলকে বলেন, ‘এ অভিযান তা কতদিন চলবে এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট সময় বলা হয়নি। তবে যতখন পর্যন্ত একটিও কালো গ্লাসের গাড়ি রাস্তায় দেখা না যাবে ততক্ষণ এ অভিযান চলবে।’

এ পর্যন্ত কালো কাচ ব্যবহারে ঢাকা মেট্রোপলিটনে কতগুলো মামলা হয়েছে জানতে চাইলে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্রাফিক সংক্রান্ত প্রতিমাসে ৫ থেকে ৬টি মামলা আসে। গতকাল দক্ষিণ অঞ্চলে ২১৭টি মামলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনার পরে এ মামলার সংখ্যা বাড়ছে।’

মামলার ধরন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে (গাড়ির) মামলা হয়েছে তারা জরিমানা দিয়েই গাড়ি চালাতে পারবে। জরিমানা না দিয়ে রাস্তায় গাড়ি বের করা হলে আরো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’

উল্লেখ, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় কালো কাচের মাইক্রোবাস ব্যবহারের অভিযোগ ওঠার পর সারা দেশে মাইক্রোবাসসহ সব ধরনের যানবাহন থেকে ১০ মের মধ্যে কালো কাচ খুলে ফেলতে নির্দেশ দেয় স্বররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল রোববার থেকে কালোকাচ লাগানো গাড়ির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে শৃঙ্খলা বাহিনী। বাংলামেইল২৪ডটকম

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত আরও সংবাদ

সাম্প্রতিক সংবাদ

আর্কাইব

Sat Sun Mon Tue Wed Thu Fri
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31  

প্রধান সম্পাদক : সাঈদুর রহমান রিমন
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ নজরুল ইসলাম আজহার

সার্বিক যোগাযোগ : চৌধুরী মল (৫ম তলা), ৪৩ হাটখোলা রোড, ঢাকা-১২০৩॥

গাজীপুর অফিস : এ/১৩১ (ইকবাল কুটির) হাবিব উল্লাহ স্মরণী, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০০॥

হটলাইন: ০১৭৫৭৫৫১১৪৪ ॥ সেলফোন : ০১৭১৬-৩৩৩০৯৬ ॥ E-mail: banglabhumibd@gmail.com

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত বাংলাভূমি ২০০৯-২০২৫