বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ কৃষিপণ্য বিক্রির পর দাম পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, তোলা তুলবার নামে চাঁদাবাজি, ওজনে কম ফেলানোসহ নানা রকমের হয়রানি যেন দেশের প্রান্তিক কৃষকদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
সব মিলিয়ে একেবারে নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে দেশের প্রায় সব অঞ্চলের কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা।
প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক ও বাজার ব্যবস্থানার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা যায়। এদিকে, বেসরকারি অক্সফাম ও এর সহযোগী কয়েকটি সংস্থার এক গবেষণায় একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে।
এসব বিষয়ে কৃষিবিদ ও বাজার বিশেষজ্ঞরা বাংলানিউজকে জানান, কৃষিপণ্যের বাজারের এই নাজুক অবস্থার জন্য কৃষকেরা পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ ক্রেতারা ঠিকই বেশিদামে পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন। আর মাঝখানে লাভবান হচ্ছেন মধ্যস্বত্ত্বকারীরা।
দ্রুত কৃষিপণ্যের বাজারের প্রতি গুরুত্ব নিয়ে নজর দেওয়ার পাশাপাশি আইনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা আশঙ্কা করছেন, এ ভাবে চলতে থাকলে কৃষকরা বিকল্প পেশায় চলে যাবেন।
মঙ্গলবার দিনাজপুর জেলার কাহাল উপজেলার প্রান্তিক নারী কৃষক বিচিত্রা বাংলানিউজকে বলেন, সকালে এক বস্তা ধান নিয়ে বাজারে যাওয়ার পর বিক্রি হতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। কিন্তু টাকার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরতে হয় ফড়িয়াদের পেছনে। ফলে, ওইদিন আর অন্য কোনো কাজে হাত দিতে পারি না।
তিনি বলেন, আমরা তো কৃষক, একদিন কাজ না করলে সেইদিনই ক্ষতি। কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করার পর বিক্রির করতে গিয়ে এরকম হয়রানি হলে খুবই কষ্ট হয়।
তিনি জানান, শুধু ধান নয়, স্থানীয় বাজারে যাবতীয় কৃষিপণ্য বিক্রি করতে গেলেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তাদের।
কৃষিবিদ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এর দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্প পরিচালক হামিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, প্রযুক্তিসহ নানাদিক দিয়ে কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু, এখনো কৃষিবাজার ব্যবস্থাপনার অবস্থা খুবই নাজুক। এ কারণে উৎপাদন বাড়লেও প্রান্তিক কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। তাই, এখনই দ্রুত এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগে কয়েকবার কৃষি বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই উৎপাদনের দিকে নজর দিচ্ছেন। অথচ যারা মূল কাজটি করছেন তাদের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
এই কৃষিবিদ মনে করেন, সমন্বয় করে কৃষকদের মাঝে বন্ধুত্বতাপূর্ণ সমবায় সমিতি গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
নাটোর জেলার কৃষক সঞ্জয় কুমার বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শ্রম এবং বিনিয়োগ করে ফসল উৎপাদন করি। কিন্তু, ব্যবসায়ীরা শুধু বিনিয়োগ করেই আমাদের চেয়ে বেশি লাভ করছেন। এটা হচ্ছে শুধু অব্যবস্থাপনার কারণে।
তিনি বলেন, পণ্য নিয়ে বিক্রি করার জন্য দাঁড়ালে প্রথমে দিতে হয় তোলা। আসলে এটা এক ধরনের চাঁদা। এরপর ওজনে ৪০ কেজিতে ৫ কেজি কমিয়ে ফেলে। কিছু বলতে গেলে শারীরিক আক্রমণ করে।
বাজার বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, কৃষক আর বাজার ব্যবস্থার মধ্য দিন দিন দূরুত্ব বেড়েই যাচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে, প্রান্তিক কৃষকদের।
তিনি জানান, এ বিষয়ে আইন রয়েছে। কিন্তু, তা সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না। বাজার পর্যবেক্ষণ বাড়ানোর পাশাপাশি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
অক্সফাম-এর গবেষণা:
বাজার বিষয়ে গবেষণায় নানা বাজার ব্যবস্থপনার নানা সংকটের তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- জনবল সংকটে বিভিন্ন জেলা অফিস সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে না। জেলা বাজার উপদেষ্টা কমিটির কার্যাবলীর সমন্বয় ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ের অভাবের কারণে জেলা বাজার উপদেষ্টা কমিটির কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
এছাড়া কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে জনবল সংকটও প্রকট। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের প্রভাবের কারণে কৃষি বিপণন অফিস এর আওতাধীন বাজারগুলো লিজ দেওয়া হচ্ছে না এবং অনেকগুলো অব্যবহৃত অবস্থায়ও পড়ে আছে। যেমন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা অবৈধ তোলা আদায়ের জন্য রংপুরের মাহীগঞ্জ পাইকারি বাজারটি কৃষকদের প্রকৃত সেবা প্রদান করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ইজারা ও তোলা আদায় বিষয়ে গবেষণায় বলা হয়, বাজার ইজারা ও তোলা আদায় এবং সরকারি বিধি মোতাবেক হাট-বাজারগুলো একজন ইজারাদারের কাছে ইজারা দেওয়ার নিয়ম, যে ইজারাদার সরকার কর্তৃক নিধারিত হারে ‘তোলা’ আদায় করতে পারবেন।
আর এই ইজারা সম্পর্কিত বিষয়গুলো তদারকি করার জন্য সরকারি জেলা কৃষি বিপণন অফিস, জেলা বাজার উপদেষ্টা কমিটি, উপজেলা বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি, ইউনিয়ন বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি, সংশ্লিষ্ট হাট বা বাজার কমিটি, মোবাইল কোর্ট।
কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, বাজার ইজারা ও তোলা আদায় সংশ্লিষ্ট ইজারদারদের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের যোগাযোগ হাট-বাজার ইজারার অন্যতম নিয়ন্ত্রক। ইজারাদার বাজার বা বাজারের বিভিন্ন অংশ স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের কাছে উচ্চ মূল্যে সাব-ইজারা দিয়ে থাকে অথবা তাদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে থাকে।
এফজিডি ও বাজার পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায় যে, বিভিন্ন ধরনের বৈধ ও অবৈধ চাঁদার কারণে প্রতি মণ ধান বিক্রি করতে কৃষককে এক কেজির উর্ধ্বে তোলা দিতে হয়। তোলার কারণে অনেক কৃষক তার ফসল অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে বাড়িতে ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করেন।
বাজার ব্যবস্থাপনায় বা কমিটিতে ক্ষুদ্রকৃষক ও নারী কৃষকদের অংশগ্রহণও নেই। আর তোলা ও পণ্যের বাজার মূল্য প্রদর্শনের জন্য কোনো বিলবোর্ড বা বোর্ড ব্যবহার করা হয় না।
এছাড়া, বাংলাদেশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ও মূল্য নির্ধারণের জন্য শক্তিশালী কোনো নীতিগত ও বাজার সম্মত নীতি কাঠামো না থাকার কারণে কৃষক কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করেন আর মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।
‘কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য সংশ্লিষ্ট ইস্যু ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো চিহ্নিতকরণ’ এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে।
এ বিষয়ে অক্সফামের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর (দক্ষিণ) আশিষ কুমার বকসি বাংলানিউজকে বলেন, উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর, রংপুর ও কুড়িগ্রামের প্রান্তিক কৃষক ও বাজার নিয়ে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। গবেষণা থেকে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছে।
গবেষণার আলোকে সুপারিশ:
সরকার ফড়িয়াদের কাছ থেকে না ক্রয় করে সরাসরি কৃষকদের কাছ ক্রয় করা, যখন দ্রুব্যমূল্য কমে যায়, তখন যেন কৃষকদের আপদকালীন ঋণ দেওয়া হয়, কৃষি সেবা সংক্রান্ত সরকারি সব দফতর এবং বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন।
স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি বিভাগের সব অফিসগুলোর সামনে কী কী ধরনের সেবা দেওয়া হয়, সেগুলোর তালিকা বিলবোর্ডের মাধ্যমে প্রদর্শন, কৃষি বিষয়ক পরিকল্পনা গ্রহণ, নীতি প্রণয়ন এবং প্রশিক্ষণ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রান্তিক কৃষকদের মতামত গ্রহণ এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত।
স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণের জন্য সংরক্ষণাগার তৈরি, ‘ক্রপ জোনিং’ কৃষি পরিকপল্পনার আলোকে ফসলভিত্তিক কৃষক দল গঠন, কৃষি বিষয়ক ২৪ ঘণ্টা ব্যাপী টেলিভিশন চ্যানেল চালু, নারী কৃষকদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য নীতিমালা সংশোধন, দেশব্যাপী প্রান্তিক কৃষকদের সক্রিয় সংগঠন তৈরি এবং সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদের উদ্যোগ গ্রহণ, সরকারি ব্যাংকগুলোকে স্পটভিত্তিক কৃষি ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, জবাবদিহিতা নিশ্চিত, নারী কৃষি শ্রমিকদের বৈষম্যহীন মজুরি প্রদান নিশ্চিত, কৃষি পণ্যের লাভজনক মূল্য নিশ্চিত করতে ন্যায্যমূল্য কমিশন গঠন। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম