বাংলাভূমি২৪ ডেস্ক ॥ সাত কুতুবের নিয়ন্ত্রণে তিতাসের অবৈধ সংযোগ কার্যক্রম। ইতিমধ্যে রাজধানীতে পৌনে ২ লাখ অবৈধ সংযোগ দিয়েছেন এ কুতুবরা। আর এর বিনিময়ে কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। বিষয়টি জানার পর এ নিয়ে হয়েছে তদন্ত কমিটি। এ কমিটি ব্যাপক তদন্ত করে তাদের দোষী সাব্যস্ত করেছে। এরপরই তাদের করা হয় চাকরিচ্যুত। এ সাত কুতুবের মধ্যে রয়েছেন সিবিএ’র ৪ নেতা। এ ছাড়া এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ৩২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে করা হয়েছে বদলি। ১৫ জনকে করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত। তিতাসের ইতিহাসে এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এই প্রথম। গতকাল বিকালে তিতাসের এমডি প্রকৌশলী মো. নওশাদ ইসলামকে তিতাস গ্যাস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন হুমকি দেয়। এতে তারা এই সংগঠনের সহসভাপতি নূরুল হক মোল্লা ও কাজী আবদুল হান্নানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে দাবি করে পুনঃ তদন্তের মাধ্যমে আসল তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ দেয়ার দাবি জানান। অন্যথায় যে কোন পরিস্থিতির জন্য তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষই দায়ী থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
সূত্র মতে, ওই সাত কুতুবের সঙ্গে চুক্তি করে অবৈধ সংযোগ দিয়েছে ২৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তদন্তে তাদের নাম বেরিয়ে আসে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানকে করা হয়েছে কালো তালিকাভুক্ত। অবৈধ গ্যাস সংযোগের বেশির ভাগই দেয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জ, সাভার, দক্ষিণখান, উত্তরখান, বাসাবো ও মাদারটেকসহ বিভিন্ন এলাকায়। অবৈধ সংযোগের সঙ্গে জড়িত যে ৭ জনকে চাকরিচ্যুতি করা হয়েছে তারা হলেন- বিক্রয় সহকারী মো. খোরশেদ আলম পাটোয়ারী, সাহায্যকারী মো. আবদুর রহিম মৃধা, হিসাব সহকারী মো. শওকত ইমাম, সুপারভাইজার এবিএম সেলিম, সুপারভাইজার কাজী আবদুল হান্নান, সিনিয়র হিসাব সহকারী মো. হামিদুল ইসলাম ও জুনিয়র প্রকর্মী মো. নুরুল হক মোল্লা। চাকরিচ্যুতির আগে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দেয়া হয় কারণ দর্শানো নোটিশও। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারায় তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। উপমহাব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) মমতাজ বেগম স্বাক্ষরিত ৭ই মে দেয়া চাকরি থেকে বরখাস্ত পত্রে বলা হয়- আপনার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগ সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশের প্রেক্ষিতে আপনার প্রদত্ত জবাব সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়া এবং গঠিত বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্তে আপনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও পান। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খ-ন করতে না পারায় তদন্তে আপনি দোষী প্রমাণিত হন। এ ছাড়া আইনগত মতামত পর্যালোচনা করে কর্তৃপক্ষ আপনাকে কোম্পানির চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অতএব, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনাকে অবিলম্বে কোম্পানির চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। সংশ্লিষ্ট বিভাগের দেনা পাওনা সনদ সাপেক্ষে কোম্পানির বেতন ও তহবিল বিভাগ থেকে অফিস চলাকালে যে কোন কার্যদিবসে আপনার পাওনা গ্রহণ এবং দেনা পরিশোধ করবেন। আপনার কাছে কোম্পানি কোন পাওনা থাকলে তা আদায় করার অধিকার কোম্পানি সংরক্ষণ করে। তদন্তে ২৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অবৈধ সংযোগ দিয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান হলো- মেসার্স হুমায়ুন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স রিজিয়া গ্যাস সার্ভিসেস, মেসার্স স্বদেশ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স শুভ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স এ আর এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স টেকনো গ্যাস সার্ভিসেস, মেসার্স সুরমা গ্যাস কোম্পানি, মেসার্স সুপারসনিক এ্যাপোলো, মেসার্স রায়হান গ্যাস কোম্পানি, মেসার্স ইসলাম এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মেট্রো কন্সট্রাকশন কোম্পানি, মেসার্স রিয়াদ গ্যাস কোম্পানি, মেসার্স গাজী গ্যাস সার্ভিসেস, মেসার্স বিক্রমপুর এসোসিয়েট, মেসার্স খান ট্রেডার্স, মেসার্স আজিজ প্রকৌশল ও নির্মাণ সংস্থা, মেসার্স জিয়া এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স নিপা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স জনতা করপোরেশন, মেসার্স আপন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স চৌধুরী কন্সট্রাকশন কোম্পানি, মেসার্স হুসাইন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স জহির ইঞ্জিনিয়ারিং, মেসার্স মা ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স আল-জাবলে নুর কন্সট্রাকশন কোম্পানি, মেসার্স আল মদিনা গ্যাস সার্ভিসেস, মেসার্স ত্রিবেনী ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স প্রাইম এন্টারপ্রাইজ। এসব প্রতিষ্ঠান আর কখনও তিতাস গ্যাস লিমিটেডের বৈধ কাজও করতে পারবে না। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ থাকার সুযোগে রাজধানীর ১৩টি শাখায় গিয়ে ধরনা দেয় গ্রাহকরা। আর এসব শাখা অফিসে ওই ৭ কুতুবের নিয়োগ করা দালাল ছিল। এসব দালালরা গ্যাস সংযোগ নিতে আসা লোকজনকে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতো। তারাই কারও কাছ থেকে ৫০ হাজার কারও কাছ থেকে লাখ টাকা নিয়ে এসব অবৈধ সংযোগ দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ এসব অবৈধ সংযোগের কথা জানতে পেরে অভিযানে যায়। তখনই লোকজন বিস্তারিত তথ্য জানায়। কাদের মাধ্যমে, কত টাকা দিয়ে তারা সংযোগ নিয়েছে তাও জানায়। একই সঙ্গে কোন প্রতিষ্ঠান অবৈধ সংযোগ লাইন দিয়েছে তাদেরও নাম বলেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে তা তদন্ত করেন। পরে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন। এতে কারা কারা দায়ী তা উল্লেখ করা হয়। তিতাসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। এমনকি তদন্ত কমিটির কাছে অভিযুক্তরা তাদের দায় স্বীকার করে নেয়। পরে তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়। সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরই তাদের চাকরিচ্যুতির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তিতাসের এমডিকে হুমকি: গতকাল বিকালে তিতাস গ্যাস এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংগঠনের প্যাডে তিতাস গ্যাস লিমিটেডের এমডি প্রকৌশলী মো. নওশাদ আলম বরাবর একটি চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, গত ৭ই মে অত্র সংগঠনের সহসভাপতি ও সংগঠনের সদস্য কাজী আবদুল হান্নানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যার বিরুদ্ধে অত্র সংগঠন তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তিতাসের সর্বোচ্চ পদে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি আসীন হওয়ার পর থেকে তিতাস গ্যাসে অবৈধ সংযোগের যে হিড়িক পড়েছে তিতাসের ইতিহাসে এরকম কখনোই হয়নি। প্রথম মহাজোট সরকারের প্রথম ৪ বছরের ইতিহাসখ্যাত তিতাসের অর্জিত সুনাম এবং সাফল্য ধরে রাখা গেল না, বরং ২০০৮ পূর্ববর্তী সময়ের চেয়েও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। যাদের দ্বারা এই সুনাম অর্জিত হলো তাদের উদ্দেশ্যমূলক ও পরিকল্পিতভাবে ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় রত তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। অবিলম্বে উল্লিখিত দু’জনসহ সকল চাকরিচ্যুতদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা পুনঃতদন্তের মাধ্যমে আসল তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ প্রদান করবেন বলে আশা রাখি। অন্যথায় উদ্ভূত যে কোন পরিস্থিতির জন্য তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষই দায়ী থাকবে। এর অনুলিপি পাঠানো হয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, শ্রম প্রতিমন্ত্রী, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। (মানবজমিন)