জেলা প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ॥ চট্টগ্রামে আটক বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় আজ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হবে। দীর্ঘ ৯ বছর টানা মামলা চলার পর চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় দিতে যাচ্ছেন চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক ও মহানগর দায়রা জজ এস এম মুজিবুর রহমান।
এ রায়কে ঘিরে ইতোমধ্যে আদালত এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে বিচারকের ব্যক্তিগত ও বাসস্থানের নিরাপত্তা। জোরদার করা হয়েছে আদালতেরও নিরাপত্তা। রায়কে কেন্দ্র করে যেন কোনো স্বার্থান্বেষী মহল নাশকতার করতে না পারেন সে ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল গভীর রাতে চট্টগ্রাম বন্দর বর্হিনোঙ্গরে জাহাজ করে আনা অস্ত্রের এ বিশাল চালানটি সিইউএফএল ঘাটে খালাসকালে ধরা পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এ নিয়ে দেশি বিদেশি সংবাদপত্র ও বিভিন্ন মিডিয়াতে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে। মামলা চলাকালে টানা ৯ বছর আলোচিত এ মামলার কার্যক্রম মিডিয়াতে স্থান পেয়েছে গুরুত্বের সঙ্গে।
গত ১৩ জানুয়ারি সোমবার দিনভর আসামি পক্ষের যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত ৩০ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে দেন। কিন্তু চট্টগ্রামের আদালতে চলা মামলার শেষ মুহূর্তে এসে এর কার্যক্রম নিয়ে হাইকোর্টে তদন্ত কর্মকর্তাকে ফের জেরার আবেদন করা হলেও আদালত তা খারিজ করে দিলে আগামীকালের রায় ঘোষণায় আর কোনো বাধা থাকলো না।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল ভোরে সিইউএফএল জেটিঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটক করা হয়। স্মরণকালের বৃহত্তম এই অস্ত্রের চালান নিয়ে কর্ণফুলী থানার সাবেক ওসি আহাদুর রহমান বাদী হয়ে চোরাচালান ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর আদালত সাতটি পর্যবেকক্ষণসহ অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। প্রায় চার বছর ধরে চলা তদন্তের পর সিআইডি’র ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামান ২০১১ সালের ২৬ জুন অস্ত্র আটক ও চোরাচালান সংক্রান্ত্র দুটি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন। এর মধ্যে এক মামলায় ৫২ জন অপর মামলা ৫০ জনকে আসামি হিসেবে দেখালেও দুটি মামলার আসামি একই ব্যক্তি।
স¤পূরক চার্জশিটে সাবেক সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আবদুর রহিম, মেজর জেনারেল (অব) রেজ্জাকুল হায়দার, পরিচালক উইং কমান্ডার শাহাবুদ্দিন আহমেদ, উপ-পরিচালক (অব) লিয়াকত হোসেন, মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, সিইউএফএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার ও মহাব্যবস্থাপক এনামুল হক, সাবেক শিল্প সচিব নুরুল আমিন, ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়াসহ ১১ জনকে নতুন করে আসামি করা হয়েছে।
এদের মধ্যে উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া ও শিল্প সচিব নুরুল আমিন পলাতক রয়েছে। বাকিরা সবাই কারাগারে আছে। আগের চার্জশিটে থাকা ৩৯ জনের নামও সম্পূরক চার্জশিটে রয়েছে। ওই বছর ১৫ নভেম্বর দুটি মামলায় চার্জ গঠনের পর একই বছর ২৯ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ৬৭ পৃষ্ঠার এমইতে তদন্ত কর্মকর্তা মামলার প্রধান আসামি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হাফিজুর রহমান ও দ্বীন মোহাম্মদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে পাওয়া তথ্যর ভিত্তিতে এএসআই কর্মকর্তা রেজ্জাকুল হায়দার, আবদুর রহিম, আকবর হোসেন খান, লিয়াকত আলীসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়।
তাদের জবানবন্দি সূত্রে গেছে, উলফার জন্যই অস্ত্রগুলো আনা হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এনএসআই কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন অস্ত্র খালাসে সহযোগিতা করেছে। মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেনও তার জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিনি অস্ত্র খালাসে জড়িত ছিলেন। তাছাড়া সংরক্ষিত সিইউএফএল জেটিতে অস্ত্র খালাস হলেও তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, সিইউএফএলের এমডি মহসিন উদ্দিন তালুকদার ও জিএম এনামুল হক এবং তৎকালীন শিল্প সচিব সিইউএফএল রেস্ট হাউসে রাত যাপন করলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। সিইউএফএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে তার উল্লেখ আছে। প্রথম চার্জশিটে দাখিল করা আসামি আবুল কাসেম মৃধা, ইয়াকুব আলী, মনির আহমেদ ও হাজী আতাউর রহমান মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের চার্জশিট থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
মামলা চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী এডভোকেট কামাল উদ্দিন আহমেদ দশ ট্রাক অস্ত্র ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য আনা হয়েছিল বলে দাবি করে বলেন, আদালতে যুক্তি উপস্থাপনকালে অধিকতর তদন্তের উপর ভিত্তি করে আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে এমন কথা বলেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সিনিয়র এএসপি মো. মনিরুজ্জামান। আর সম্পূরক অভিযোগপত্রে উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকে আসামি করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলী বলেন, ঘটনার সঙ্গে উলফা জড়িত। না হলে উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকে আসামি করা হল কেন? সাক্ষীদের সাক্ষ্যেও উঠে এসেছে, উলফার জন্যই অস্ত্রগুলো আনা হয়েছিল এবং বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে সেগুলো ভারতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল।
কামাল উদ্দিন আহমদ বলেন, সাক্ষ্য প্রমাণসহ এসব বক্তব্য আদালতের কাছে আমি তুলে ধরেছি। রায়ে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আমি আশা করছি।
তবে আসামী পক্ষের আইনজীবি এডভোকেট কফিল উদ্দিন আহমদ জানান, অধিকতর তদন্তের নামে যে চার্জশিট দেয়া হয়েছে সেটা পুরোটাই প্রহসন। সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদের এই মামলায় আসামি করেছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় আদালত এই মামলা থেকে আসামিদের বেকসুর খালাস দেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। শীর্ষ নিউজ